আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
আধুনিক উপায়ে খেজুর রসের উপজাত ব্যবহার করে সম্ভাবনাময় নানা রপ্তানী পণ্য উৎপাদন করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক নীতিমালা ও পৃষ্ঠপোষকতা। এতে আবার ফিরে আসবে মাগুরার খেজুরের রস-গুড়ের হারানো ঐতিহ্য।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় একসময় এ অঞ্চলের খেজুরের গুড় থেকে উৎপাদন হত বাদামী চিনি । খেজুর গুড়, পাটালি ও বাদামী চিনির খ্যাতি ছিল সারা বিশ্বে। খেজুর গুড় শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক বিশাল বাণিজ্য। যা এখন শুধুই ইতিহাস।
বিশেষজ্ঞরা আশার কথা বলছেন, খেজুরের রস গুড় থেকে আবারো ব্রাউন সুগার কারখানা চালুর উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। গুড়-পাটালির পাশাপাশি খেজুর রসের উপজাত থেকে জুস, জেলি, প্রাকৃতিক ভিনেগার ও সিরাপ এমনকি ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ বা ফরেন লিকারসহ’ নানা পণ্য তৈরি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
এতে খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য ও গৌরব আবার ফিরে আসবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের বিশাল কর্মযজ্ঞ। উন্মোচিত হবে অর্থনীতির এক নতুন দ্বার।
জানা গেছে, শীতের শুরুতেই মাগুরার গ্রামীণ জনপদের সর্বত্র ‘মধুবৃক্ষ’ খ্যাত খেজুরগাছ থেকে রস আহোরণ শুরু হয়। সুমিষ্ট খেজুরের রস জ্বালিয়ে তৈরি হয় দানা, ঝোলা, নলেন গুড় ও পিঠা-পায়েস । যার স্বাদ ও ঘ্রাণই আলাদা। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। গুড় ও পাটালি উৎপাদন অনেক কমে গেলেও গ্রামবাংলায় এখনো চালু আছে।
এ এলাকার খেজুর রস-গুড়-পাটালি প্রসিদ্ধ। শীত মৌসুমে খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড়-পাটালি তৈরি ও বিক্রি করে জেলার চারটি উপজেলার প্রায় দশ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। খেজুরগাছ থেকে যারা রস সংগ্রহ করেন স্থানীয়ভাবে তাদের গাছি বলা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, মাগুরা সদর শ্রীপুর, মহম্মদপুর ও শালিখা উপজেলায় এ বছর প্রায় প্রায় এক লাখ খেজুর গাছ থেকে দেড় হাজার টন গুড় উৎপাদন হবে। এসব গাছ থেকে শীতের শুরুতেই রস আহোরণ শুরু হয়। যা থেকে নলেন গুড় ও পাটালি উৎপাদিত হয়। মাগুরার রসের স্বাদ যেমন সুমিষ্টি তেমনি এর তৈরী গুড় ও স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়।
অযত্নে ও অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুর গাছের জন্য বাড়তি জমির প্রয়োজন হয় না। কোন খরচ নেই কিন্তু পুরোটাই লাভ। উপরন্তু ভূমি ক্ষয়, আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগরোধে ভূমিকা রাখে খেজুর গাছ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শীত আসতেই, গ্রামীণ জনপদে শুরু হয়েছে খেজুরগাছ কাটা আর গুড়-পাটালী তৈরির প্রস্তুতি। এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে কম-বেশী খেজুর গাছ নেই। এ সব গ্রামের গাছিরা খেজুর রস সংগ্রহের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
জানা যায়, বৃহত্তর যশোরের অন্তর্গত মাগুরার ঐতিহ্যবাহী গুড় পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। অতীতে সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ জন্মাত এ অঞ্চলে। অর্থকরী ফসল বলতে খেজুর গুড়ের বেশ কদর ছিল। ধান উৎপাদনে জমির ব্যবহার ছিল স্বল্প। পড়ে থাকত বন-জঙ্গলে ভরা দিগন্তজোড়া মাঠ। আর সেখানে বিনা রোপণ ও বিনা পরিচর্যায় বুনোলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠত খেজুরগাছ। তা থেকে রস বের করে তৈরি হতো উৎকৃষ্ট গুড়।
ব্রিটিশ আমলে খেজুর গুড় থেকেই তৈরি হতো চিনি। এ চিনি ‘ব্রাউন সুগার’ নামে পরিচিত ছিল। খেজুরের রস থেকে উন্নতমানের মদও তৈরি করা হতো। এই চিনি ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো। বিলেত থেকে সাহেবরা দলে দলে এ অঞ্চলে এসে চিনির কারখানা স্থাপন করে চিনির ব্যবসায় নামেন।
যশোর ও তার আশপাশে প্রায় ৫০০ চিনি কারখানা গড়ে উঠেছিল। তখন কলকাতা বন্দর দিয়ে খেজুর গুড় থেকে উৎপাদিত চিনি রপ্তানি করা হতো। মূলত ১৮৯০ সালের দিকে আখ থেকে সাদা চিনি উৎপাদন শুরু হলে খেজুর গুড় থেকে চিনির উৎপাদনে ধস নামে। একে একে কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। খেজুরের গুড় থেকে চিনি তৈরি না হলেও এখন পর্যন্ত বাঙালির রসনা বিলাশে খেজুর গুড় পাটালির কদর একট্ওু কমেনি।
সূত্র জানায়, গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্য খেজুররস ও গুড় আজ বিলুপ্তির পথে। কিছু অসাধু মানুষের অধিক মুনাফার আশায় হারাতে বসেছে খেজুর রসের নাম যশ। খেজুরের রসের মধ্যে চিনি মিশিয়ে কম খরচে অধিক গুড় বা পাটালি তৈরি করে প্রতারণা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা গাছিদের কাছ থেকে গুড় কিনে আবার চিনি মিশিয়ে পাটালি করে বাজারজাত করছে।
খেজুরের গুড় তৈরি ও সংরক্ষণের জন্য আজও আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এখনো রস থেকে গুড় পাটালি তৈরিতে মান্ধাতা আমলের পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। গুড় পাটালি তৈরিতে আধুনিকতা আনা গেলে এটিও রপ্তানি পণ্যের তালিকায় স্থান পেত।
সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত গুড়ের নায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন চাষীরা। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে খেজুরের রস-গুড় প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে। শুধু গুড় নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আধুনিক পদ্ধতিতে খেজুরের রসের উপজাত ব্যবহার করে নানা পন্য উৎপাদন করা সম্ভব।

magura-date-plant-picture-03-1
ডিস্টিলারির মাধ্যমে খেজুর রসকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ বা ‘ফরেন লিকার’, পিউরিফায়েড অ্যালকোহল, কান্ট্রি স্পিরিট, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, এক্সট্রা নিউট্রাল অ্যালকোহল (ইএনএ), ডিনেচার্ড স্পিরিট, অ্যাবসলিউট অ্যালকোহল, মল্টেড ভিনেগার ও সাদা ভিনেগার তৈরি করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। এজন্য সড়ক পথ, জমির আইল, পতিত জমি ও বাড়ীর আঙ্গিনায় কোটি কোটি খেজুর গাছ লাগানোর সুযোগকে কাজে লাগাতে সরকারী উদ্যেগ নিতে হবে।
মহম্মদপুর উপজেলা সদরের গাছি আব্দুস সালাম বলেন,‘খেজুরের রস-নলেন গুড় ও পাটালির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যত্ন সহকারে কাটলে একটি খেজুর গাছ থেকে মওসুমে প্রায় ১০ থেকে ১৫ কেজি গুড় উৎপাদন করা সম্ভব। যার বাজার মূল্য দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।

সম্প্রতি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার কাজলী গ্রামে খেজুর রস জ্বালিয়ে বিশেষ কায়দায় বোতলজাত করে ইউরোপ আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সে প্রচেষ্টা প্রসার লাভ করেনি বলে জানা গেছে ।
মাগুরা জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থের লেখক সালাহ্ উদ্দিন আহমেদ জানান, একসময় মাগুরা ও তার আশপাশের এলাকায় নানা কারণে খেজুরগাছ অনেক কমে গেছে। সরকার অন্যান্য ফসলের খেজুর গাছের চাষ সম্প্রসারণে পদক্ষেপ নিলে গ্রাম বাংলার ‘ঐতিহ্য গাঁথা’ গৌরব আবারো ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
মাগুরা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক পার্থ প্রতীম সাহা বলেন, ‘প্রাকৃতিক উৎস খেজুরের রস-গুড় থেকে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করতে পারলে প্রাচীন এ অর্থকরী ফসলকে ঘিরে তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনা। খেজুর রস সংরক্ষণ ভিত্তিক শিল্প তৈরির উদ্যেগ নিলে পাল্টে যাবে গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা।’

 

রূপক আইচ/ শাহীন/ ৩ ডিসেম্বর১৬