মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় আবারও মধুমতি নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে।বর্ষার পানি কমা শুরুর সাথে সাথে ভাঙ্গন বেড়ে গেছে বহুগুন। ঘরবাড়ি, ফসলের জমি ভেঙ্গে নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো মানুষ।

চলতি বর্ষা মৌসুমে নদী তীরবর্তী তিনটি ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের লোকজনের মধ্যে এখন বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। এসব এলাকায় ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ। গত দুই সপ্তাহে নদী গ্রাস করছে প্রায় দেড় হাজার একর আবাদি জমি, গাছপালা বসতভিটা মসজিদসহ কয়েকশ স্থাপনা। ভাঙনের মুখে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক স্থাপনা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে আতঙ্কে অনেকেই বাড়ি-ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন ।

ভাঙন কবলিত এলাকার বাসিন্দারা জানান, ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী তৎকালিন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহাবুবুর রহমান মধুমতি তীরবর্তী সবচেয়ে ভাঙনকবলিত কাশিপুর গ্রাম পরিদর্শন করেন। ভাঙন প্রতিরোধে কাজ শুরু হবে বলে ক্ষতিগ্রস্থদের প্রতিশ্রুতি দেন। তিন বছর পর এবার নদী শাসনের জন্য ব্লক নির্মাণ কাজ শুরু হলেও চলতি বর্ষা মৌসুমে কাজে না আসায় ক্ষুব্ধ মধুমতি পারের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন।

সরেজমিন মধুমতির ভাঙ্গন কবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মহম্মদপুর সদর, দীঘা, পলাশবাড়িয়া ও বাবুখালী ইাউনিয়নের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতির পূর্বতীরে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেঙে গেছে। ম‏হম্মদপুর সদর ইউনিয়নের গোপালনগর, কাশিপুর, ধুলজুড়ী, মুরাইল, রায়পাশা, ভোলানাথপুর, পাচুড়িয়া, রুইজানী ও পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের ঝামা, আড়মাঝি, দেউলী, যশোবন্তপুর, কালিশংকরপুর গ্রামগুলো তীব্র ভাঙন কবলিত। এসব এসব এলাকার নদী তীরের অসংখ্য বসতবাড়ি ইতোমধ্যেই নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গছে। অসংখ্য স্থাপনা বসতঘর, কৃষি জমি ও গাছপালা হুমকির মুখে রয়েছে।

লোকজন বাড়ি ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে গাছপালা বিক্রি করে দিচ্ছেন। উপজেলার সবচেয়ে প্রাচীন কবরস্থান কাশিপুর গোরস্থান থেকে ৫০ গজ দূরে ফুঁসছে মধুমতি। নদী ক্রমেই বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের দিকে এগিয়ে আসছে। ২০কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এ বাঁধ ভেঙে গেলে হুমকির মুখে পড়বে উপজেলার বিস্ত্রীর্ণ জনপদ। মধুমতির হাত থেকে মহম্মদপুর উপজেলাকে রক্ষা করতে সরকারি কোন উদ্যেগ চোখে পড়ছে না।

সরেজমিন দেখা গেছে, মধুমতি তীরবর্তী জনপদের বসতিদের মধ্যে এখন বিরাজ করছে তীব্র ভাঙন আতঙ্ক। লোকজন তাদের বসতঘরগুলো এমনভাবে নির্মাণ করছেন, যাতে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া যায়। পানির দামে গাছপালা বিক্রি করে দিচ্ছেন । কোন বাড়ির ভিটিই পাকা নয়। নদীভাঙনে পাঁচ থেকে সাতবার বসত ভিটা সরিয়ে নিয়েছেন এমন পরিবারের সংখ্যা অনেক। নদীর পানি কমে যাওয়ার সাথে যোগ হয়েছে বৃষ্টিযোগ হওয়ায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে মধুমতি।

ভাঙনকবলিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মধুমতির ভাঙনে এসব এলাকার অনেক অবস্থাপন্ন পরিবার এখন নিঃস্ব, পরের জমিতে আশ্রিত। কেউ দিনমজুর কিংবা নৌকার মাঝি। অনেকে সহায়সম্বল হারিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্যত্র।

কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা জয়েন উদ্দিন মোল্যা (৮০), সাদেক মোল্যা (৬০),মোসলেম মোল্যা (৫৫), হারুন মোল্যা (৬৫), হানিফ মোল্যা (৫৬), মান্নাফ মোল্যা (৫০) , নওশের মোল্যা (৪৫), রুইজানি গ্রামের প্রিয়নাথ চৌধুরী (৫০), ভোলানাথপুরের সচিন বিশ্বাস (৬৫), ধুলজুড়ি গ্রামের নূরুল মাস্টার (৫০), পান্নু মোল্যা (৫০) ও আজম মোল্যার (৫০) সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক সময় তারা অবস্থাপন্ন ছিলেন। গোয়াল ভরা গরু ছিল। ঘরবাড়ি, পুকুর ফসলি জমি সবই ছিল। চোখের সামনে শেষ সম্বল বাপ-দাদার ভিটে নদীতে বিলীন হওয়ার দৃশ্য অসহায়ের মতো চেয়ে দেখছেন।

রুইজানি গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য তারাপদ চৌধুরী বলেন, ‘মধুমতি আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। আছে শুধু বসত ভিটা। চারবার ঘর সরিয়েছি। এবার মনে হচ্ছে শেষ রক্ষা আর হবে না।’

2

কাশিপুর গ্রামের বৃদ্ধ জয়েন উদ্দিন মোল্যা (৮০) বলেন, ‘বসত ঘর থেকে ৩-৪ হাত দূরে মধুমতি ফুঁসছে। ভাঙনের শব্দে রাতে ঘুম আসে না। আতঙ্কে থাকি কখন যেন শেষ স্বম্বল ভিটে মাটি গিলে খাবে নদী।’
গোপালনগর গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ কলিম উদ্দিন (৮০) বলেন, ‘আমার চোখের সামনে গ্রামডা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এ পর্যন্ত সাড়ে তিন শ থেকে চার শ ঘর গাঙে (নদী) গেছে। গ্রামের ১০০ থেকে ১৫০ বিঘা জমিও গ্রাস করেছে নদী। মধুমতি যে রকম রাক্ষুসী হয়ে উঠেছে, তাতে আরও কত কী যাবে, তার ঠিক নাই।’

একই গ্রামের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম মাস্টার বলেন, ‘আমাদের বাড়ি, পুকুর, গোয়ালঘর, ২০ বিঘার মতো জমি সবই নদীতে গেছে।’
ঝামা গ্রামের বাসিন্দা রাজা মিয়া বলেন,‘মধুমতি তাদের সব কেড়ে পথে বসিয়ে দিয়েছে। সাজানো সংসার এখন সব ছারখার।’

মহম্মদপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামান বলেন, ‘বহুদিন ধরে এখানে ভাঙন চললেও সরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নদী এখন কয়েকটি পয়েন্টে শহর রক্ষা বাধের একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। এই বাঁধ ভেঙে গেলে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়বে।’

মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাাহীন হোসেন জানান, মধুমতির ভাঙন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন বলে জানান।’

মাগুরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ বলেন, মধুমতির ভাঙনরোধে কাশিপুর এলাকায় একটি প্রকল্পের কাজ চলছে।’

মাগুরা-২ (মহম্মদপুর-শালিখা) আসনের সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ্রী বীরেন শিকদার বলেন, ‘নদী শাসনের কাজ শুরু হয়েছে। সামনে আরও প্রকল্প নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।’

সম্পাদনা : রূপক আইচ, ৯ সেপ্টেম্বর ১৬