মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরই জীবনে লক্ষ থাকে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। কিন্তু অনেকেরই তা হয়ে উঠে না।  ব্যতিক্রমী একজন আছেন। যিনি ডাক্তার হতে চাননি। চেয়েছিলেন শিক্ষক হতে। তাইতো ডাক্তারিতে  পড়ার সুজোগ পেয়েও নিজ এলাকায় শিক্ষকতাকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। রংপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির কিছুদিন না যেতেই নিজ এলাকায়  বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। শুধু তাই নয় দীর্ঘ ৩৬ বছরের শিক্ষকতার জীবনে তিনি এক দিনের জন্যও ছুটি না নিয়ে হয়েছেন ইতিহাসের অংশ। তিনি আর কেউ নন- মহম্মদপুর আরএসকেএইচ ইন্সটিটিউটের গণিত শিক্ষক স্বপন কুমার চক্রবর্তী। 

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য নানা চড়াই উতরাইয়ের পরও বিগত ৩৬ বছর ধরে ছুটি না নিয়েই শিক্ষকতা করছেন এই কিংবদন্তী শিক্ষক। আর তাইতো তিনি এলাকার মানুষের কাছে খ্যাতি পেয়েছেন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে।

গণিত-বিজ্ঞানের প্রবাদপ্রতিম এই পন্ডিত শিক্ষকের নাম স্বপন কুমার চক্রবর্তী।  তিনি উপজেলা সদরের পূর্বনারায়নপুর গ্রামের বাসিন্দা।

নিজে ডাক্তার হতে পারেননি বলে আক্ষেপ নেই। নিজের হাতে গড়া অসংখ্য শিক্ষার্থী আজ চিকিৎসক, বিজ্ঞানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বড় প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তা। মানুষ গড়ার কারিগরের নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে উজাড় করার গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

স্থানীয় অভিভাবকেরা মনে করেন, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা স্বপন চক্রবর্তীর মতো নিষ্ঠাবান হলে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা বদলে যেত।

স্বপন কুমার চক্রবর্তী ১৯৫৭ সালে নিন্ম মধ্যেবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ছাত্র জীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। বর্তমান কর্মস্থল আর এস কে এইচ ইনস্টিটিউশন থেকে মেট্রিক পাশ করেন। উচ্চ মধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই তিনি এই স্কুলে খন্ডকালিন শিক্ষকতা শুরু করেন।

এইচএসসি পাশ করার পর ১৯৭৯ সালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে (রোল নম্বর ১৯৪) ভর্তি হন।

মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়ি আসলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হাই মিঞা তাকে স্কুলে আসার জন্য খবর দেন। এক সন্ধ্যা বেলা বিদ্যালয়ের এক কোনে নির্জনে ডেকে নিয়ে হাই স্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,‘স্বপন তুই স্কুল থেকে চলে গেলে আমার স্কুলটা অচল হয়ে যাবে। শীতের দেশ রংপুরে তোর ডাক্তারি পড়ার দরকার নাই।’

স্যারের কথা তিনি উপেক্ষা না করে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে শিক্ষকতায় ফিরে আসলেন। তাছাড়া বাবা শিবনাথ চক্রবর্তীও চাইতেন ছেলে শিক্ষকতা করুক।

১৫ অক্টোবর ১৯৭৯ সালে তিনি সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮০ সালে এমপিওভূক্ত হন। পরে তিনি বিএসসি ও বিএড উত্তীর্ণ হন। ২০১০ সালে তিনি একই বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। চলতি বছরে মাত্র চার মাস পরে তিনি চাকরি থেকে অবসরে যাবেন।

৩৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এক দিনও প্রাপ্য নৈমিত্তিক ছুটি কাটাননি তিনি। সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার ও নির্দিষ্ট ছুটির দিন বাদে রোজ স্কুলে গেছেন মহম্মদপুর উপজেলা সদরের আরএসকে এইচ ইনস্টিটিউশনের এই শিক্ষক।

বাবার মৃত্যু, স্ত্রীর অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। স্কুলের হাজিরা বই ও অন্যান্য কাগজপত্র ঘেঁটে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।

স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ১৯৮৫ সালের আগস্টের কোন এক শনিবার। স্কুলে যাওয়ার আগে পুকুরে গাসল করতে নামেন। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে শামুকে পা কেটে যায়। পুকুরের পাড়ে উঠে রক্ত বের হওয়া দেখে তিনি জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফেরার পর সবাই তাকে স্কুলে যেতে নিষেধ করেন। তারপরও ১১টা বাজার কয়েক মিনিট আগেই ক্লাসে পৌঁছাতে পেরেছিলেন সেদিন। এরকম অসংখ্য ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন তিনি।

বাবা শিবনাথ চক্রবর্তী মারা যান ১৯৯৬ সালের ২১ জুন রাত সাড়ে ১১ টার দিকে। দিনটা ছিল শুক্রবার। বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে পরদিন শনিবার সময়মতো স্কুলে হাজির হন স্বপন চক্রবর্তী।

পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। একটু থেমে বলেন, ‘প্রথম সন্তানের জন্ম হয় বাড়িতে। ছেলে হওয়ার খবর শুনে মনে সে কী আনন্দ! ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই ছুটে যাই। কিন্তু স্কুল তো খোলা। তাই ছুটির পর গিয়ে দেখে আসি ফুটফুটে ছেলেটাকে।’

মহম্মদপুর উপজেলা সদরে আর এস কে এইচ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪০ সালে। স্বপন চক্রবর্তীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আশির দশক থেকে বিদ্যালয়ের সুনাম চারদিক ছড়িয়ে পড়ে। আজও সে সুনামের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে।

উপজেলায় সরকারি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। বরাবরই এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জেএসসি ও এসএসসি ভালো ফল করে আসছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সেরা স্কুলের তালিকায় রয়েছে। বিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষিত হয়ে দেশে-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত আছেন।

১৯৮১ সালে আকবর রেজাউল হায়দার নামের তার স্কুলের ছাত্র এসএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থার লাভ করে। ১৯৯৪ সালে দিপঙ্কর বিশ্বাস মেধা তালিতায় ১৪ তম স্থান লাভ করে। এসব শিক্ষার্থী স্বপন স্যারের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ছিলেন বলে তাদের অভিভাবকেরা জানান।

স্ত্রী রেখা চক্রবর্তী ও তিন ছেলে নিয়ে স্বপন চক্রবর্তীর সংসার । তিন ছেলেই জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বড় দুই ছেলে শরদিন্দু চক্রবর্তী, সৌমিত্র চক্রবর্তী দর্শন ও পরিসংখ্যন বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করেছে। ছোট ছেলে শোভন চক্রবর্তী নাট্যতত্ব বিষয়ে পড়া লেখা করছে। ছেলেরাও বাবার মতো অত্যন্ত মেধাবী।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, স্বপন কুমার চক্রবর্তী এ জনপদের আলোর দিশারি। নিজের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিমধ্যে সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে বিদ্যালয়ে টানা সময় দিচ্ছেন। ৩৬ বছরের বেশি চাকরিজীবনে এক দিনও ছুটি নেননি তিনি। তার এই ত্যাগ অনুসরণযোগ্য।’

স্বপন চক্রবর্তীর ছাত্র বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক এস এম. রেজাউল করিম বলেন, ‘গণিত বিজ্ঞানের পাশাপাশি সকল বিষয়ে স্যারের অঘাত পান্ডিত্য রয়েছে। স্বপন স্যার সারা জীবন শিক্ষার্থীদের পিছনে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। বিনিময়ে কী পেলেন, কী পেলেন না তার হিসাব মিলিয়ে দেখেননি কখনো। স্যারকে নিয়ে আমরা গর্ব করি।’

ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের আরেক শিক্ষক শহিদুর রহমান স্বপন স্যারের ছাত্র। তিনি জানান, ‘স্যারের অনুপ্রেরণা ও কার্যকরি পাঠদানের ফলেই আমরা এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি। হাটে-মাঠে-ঘাটে যে কোন সমস্যা নিয়ে আমরা হাজির হয়েছি। স্যার সমাধান করে দিয়েছেন।’

তাঁর ছাত্রী স্কুল শিক্ষিকা বাসনা রায় বলেন- শিক্ষক হিসেবে স্যার যেমন নমস্য। মানুষ হিসেবেও তিনি অনুসরণযোগ্য। তিনি সব সময় আমাদের  সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধা দিয়ে শিক্ষার গুনগত মান উন্নয়নে কাজ করার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। 

সম্প্রতি স্বপন চক্রবর্তীর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার স্ত্রী রেখা চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সময়মতো তিনি স্কুলে গিয়ে হাজির হন। রান্না একটু দেরি হলে না খেয়েই চলে যান। কখনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার দরকার হলে বন্ধের দিন যান। লোকে যখন তার প্রশংসা করে তখন আমারও গর্ব হয়।’

স্বপন চক্রবর্তী বলেন, ‘৩৬ বছরে ৭২০ দিন আমার প্রাপ্য ছুটি নিইনি। এই ৭২০ দিন শিক্ষার্থীদের বেশি পড়াতে পেরেছি। আমরা যদি অযথা ছুটি না নিয়ে কাজ করি, তবে দেশ এগিয়ে যাবে। কী পেলাম, কী পেলাম না তার হিসাব কখনো করিনি। নিজে ডাক্তার হতে পারিনি, আফসোস নেই। অসংখ্য শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ তৈরির জন্য কাজ করেছি, এটাই আমার বড় অর্জন। তার চিন্তাচেতনা ধ্যান-জ্ঞান সব কিছুই স্কুল আর শিক্ষার্থী ঘিরে- তিনি বলেন।’

বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জুবায়ের রহমান ও মুশফিকা রহমান বলেন, ‘স্বপন স্যার বিদ্যালয়ের অন্য সব শিক্ষকের চেয়ে আলাদা। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা স্যারকে এক দিনও অনুপস্থিত দেখিনি ।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম নাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বপন চক্রবর্তী সরাসরি আমার স্যার। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এখন পর্যন্ত ৩৬ বছরের চাকরিজীবনে স্যারকে ছুটি নিতে দেখিনি। এমন নজির অন্য কোথাও আছে কি না জানা নেই। এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। আমরা সচরাচর বলি শিক্ষকতা মহান পেশা। স্বপন স্যারের মত  মানুষরাই শিক্ষকতাকে মহান করেছেন। ’