কলেজ হোস্টেল ছেড়ে  বিদেশ পাড়ি সেও  প্রায় ১৩ বছর আগের কথা। বরকত এখন বিদেশে ভালই আছে। করোনায় দেশ সহ সমগ্র বিশ্ব যখন আক্রান্ত। তখন বরকতের মনে পড়ে গেল ১৩  বছর আগের কলেজ হোস্টেলের আলেয়া চাচির কথা। আলেয়া অতি অল্প টাকায় পরম মমতায় তাদের রান্না করে  খাওয়াতেন। মায়ের যন্তে রাখতেন। আজ যখন আলেয়ার খবর কেউ নেয়না। সে সময় সুদুর বিদেশ বিভুইয়ে বসে আলেয়াকে খুজে দেয়ার দায়িত্ব দিলেন মহম্মদপুরের সাংবাদিক ও শিক্ষক আনোয়ার হোসেন শাহীনকে। তৈরী হলো মরুভূমির বুকে সবুজ মরুদ্যানের ছায়াময় সময়।  নিজের ফেসবুক পেজে শাহিন লিখেছেন করোনাকালে এক অন্য রকম মানবিকতার গল্প…..
আনোয়ার হোসেন শাহীন, মহম্মদপুর

দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বরকত উল্লাহর ফোন। মহম্মদপুরের দীঘার পাল্লা গ্রামের ছেলে। ভাই একটা মানুষ খুঁজে দিতে হবে। নাম ঠিকানা বলেন। কিছুই জানিনা। অবাক হলাম। ঠিক আছে, বর্ণনা দিন। ২০০৭/০৮ সালের কথা আমিনুর রহমান কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। কলেজের হোস্টেলে থাকার সময় এক চাচি আমাদের রান্না করে দিতেন। তিনি আমাকে খুব ভালো বাসতেন। অনেক যন্ত করতেন। চাচিকে খুঁজে দিতে হবে।

তিনি কোথায় আছেন কেমন আছেন। জানতে ইচ্ছা করে। তিনি যদি বেচে থাকেন ভালো না থাকেন আমি পাশে দাঁড়াতে চাই। তবে তার একমাত্র ছেলে পেশায় ভ্যান চালক বলে শুনেছি।

সাথে সাথেই আমিনুর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় জনাব বিপ্লব রেজা বিকোর কাছে ফোন দিলাম। তিনি বললেন সন্ধান দিতে পারব। আশান্বিত হলাম। কিছুক্ষণ পরেই অধ্যক্ষ মহোদয়ের ফোন। নিশ্চিত কোনো ভালো খবর। যাকে খুঁজছ তার ছেলে ভ্যান চালায়, নাম সাইফুল। বাড়ির সদরের রাজবাড়ির আশপাশে।

তর সইছিলোনা্। বের হয়ে পড়লাম। চৈত্রের দুপুরে সূর্য কেবল পশ্চিম দিকে সামান্য হেলতে শুরু করেছে। প্রচন্ড রোদ জানান দিচ্ছে এখন গ্রীষ্মকাল। ভ্যান চালক সাইফুলের নাম বলতেই সহজেই বাড়ি পেয়ে গেলাম। সদরের সীতারাম রাজার রাজবাড়ির লক্ষী নারায়ন পুকুরের পূর্ব দিকে ফাঁকা ফসলের মাঠের মধ্যে ছোট্ট এক টিনের ঘরে বাস করেন আলেয়া বেগম। যাকে এতক্ষণ ধরে খোঁজ করছি।

সব কিছু মিলে গেল। ইনিই সেই বরকত উল্লাহর প্রিয় চাচি। আলেয়া বেগম। সঠিক বয়স বলতে পারেন না। চেহারায় সারা জীবনের কষ্ট আর জীবন সংগ্রামের ছাপ স্পষ্ট।

আলেয়া বেগম জানান, ২০০০ সাল থেকে একটানা ১৫ বছর মাসে পাথাপিছু বিশ টাকা মজুরিতে আমিনুর রহমান কলেজ হোস্টেলের ছাত্রদের তিন বেলা খাবার রান্না করতেন। তার রান্না খাবার খেয়ে লেখাপড়া করে দেশ-বিদেশে অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত। শুনেছেন কেউ দেশে বড় চাকরি করেন। ছাত্রদের জন্য সবসময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন যত্ন করে রান্না করেছেন। বাড়ি থেকে আলাদা করে মাংস-সেমাই রান্না করে খাইয়েছেন তাদের। জ্বর হলে সেবা-যত্ন করেছেন। এখন আর কাজ করতে পারেন না।

হোস্টেলও বন্ধ হয়ে গেছে। শরীরে বাসা বেধেছে নানা জটিল অসুখ। একটু হতাশার সুরে বললেন. তার খবর এখন কেউ রাখে না। মূল বাড়ি ধোয়াইল। স্বামী পরিত্যাক্তা। এক ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে তার বসবাস। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে স্ত্রী নিয়ে পৃথক সংসারে। আলেয়া বেগমের নিজে খাবার নিজেরই যোগাড় করে খেতে হয়।

সবাই ভুলে গেলেও ভুলে যাননি দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী বরকত উল্লাহ।বরকত কে জানালাম । প্রিয় চাচির সন্ধান পাওয়া গেছে।বরকত অনেক খুশি। বরকত অনুরোধ জানায়, যদি কিছু মনে না করেন- আমি কিছু টাকা পাঠাচ্ছি চাচির জন্য এক মাসের খাবার কিনে যদি চাচির বাড়িতে পৌছে দিতেন উপকার হতো। আমি মনে মনে বললাম, আমি এই কাজই তো খোঁজ করছি। নিজের তেমন সামর্থ নাই্ । অন্যের মাধ্যমে যদি কারো উপকারে আসতে পারি।

১১ এপ্রিল ২০২০। দুপুর দেড় টা। বরকত উল্লাহের টাকায় চাচির জন্য এক মাসের খাবার চাল ডাল তেল আলু পেয়াজ ও হলুদ কিনে ভ্যানে তুললাম। সোজা অধ্যক্ষ জনাব বিপ্লব রেজা বিকোর বাড়ির সামনে। চলুন ভ্যানে উঠুন। উনি অনুরোধের ঢেঁকি না গিলে পারলেন না। প্রচন্ড রোদ। ভ্যান বাড়ী পর্যন্ত যায় না। কিছু পথ হেটে আলেয়া বেগমের বাড়ি পৌছালাম।

আলেয়া বেগম কী করবেন কী বলবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বললাম বরকত আপনার জন্য খাবার পাঠিয়েছে। চোখের কোনায় চকচক করে উঠল। কিছুক্ষণ পর আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। আলেয়া বেগমের চোখে আজ আনন্দ অশ্রু। অধ্যক্ষ মহোদয় তাঁর হাতে খাদ্য সামগ্রী বুঝিয়ে দিলেন।

আমরা ফিরলাম বাড়ির পথে। কিছুদূর গিয়ে পেছনে ফিরতেই দেখি। আলেয়া বেগম আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে দাড়িয়েঁ আছেন।

এ খাবারে হয়ত আলেয়া বেগমের জীবন কেটে যাবে না। তাঁর সব সমস্যার সমাধান হবে না। তারপরও বরকত উল্লাহর সৌজন্যে আমরা আলেয়া বেগমের বাড়িতে গিয়ে কিছু খাদ্য সহায়তায় অংশীদার হতে পেরেছি এই ভেবে ভালো লাগছে।

করোনায় বদলে যাওয়া পৃথিবীতে শিখিয়ে দিয়ে গেলো অনেক কিছু। আর বরকত উল্লাহ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে শেখালো কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।

ধন্যবাদ বরকত উল্লাহ। ধন্যবাদ আলেয়া বেগম। আপনারা দুজনই ভালো থাকবেন।