আজ ৩০ মার্চ। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাকিস্থানি হানাদারেরা হত্যা করে  কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত চিকিৎসক জনাব একেএম ফারুক কে। শহীদ একেএম ফারুকের বড় ছেলে একেএম তারেক দীর্ঘদিন মাগুরা জেলা প্রশাসনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জনাব তারেকের পারিবারিক নাম সোহাগ। জনপ্রিয় এ অফিসারের পরিবারের সঙ্গে মাগুরার মানুষের রয়েছে হৃদয়ের সম্পর্ক । জনাব তারেকের স্ত্রী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আকতারী শিফা  সে দিনগুলির বর্ণনা করেছেন নিজ ফেসবুক ওয়ালে। লেখাটি হুবহু মাগুরাবার্তার পাঠকদের জন্য  প্রকাশ করা হলো……

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট। মা-বাবার নতুন সংসার। কোল আলো করে এক নতুন অতিথিও এসেছে। মায়ের নতুন সংসারে জলতরঙ্গের মত ছুটোছুটি। ডাক্তার বাবারও ছুটোছুটি অফিস আর রুগি নিয়ে। তারপর বাসায় ফিরেই ছেলেকে নিয়ে জাপটা-জাপটি। ছেলেকে শুন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার কোলে তুলে নিলেই বাপ বেটা হেসেই লুটোপুটি। বাবা আপনমনে গুনগুনিয়ে গাইতে থাকে—- সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি নাচো তো দেখি…….. সেই থেকে সোহাগ নামটিই রয়ে গেল সোহাগের।

একাত্তরের উত্তাল মার্চের হাওয়া লেগেছে সবখানে। সবাই কেমন যেন চকিত চাহনিতে থাকে। মনটা শুকিয়ে থাকে সবসময়। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও গুলির আওয়াজ। টান টান উত্তেজনা ক্যান্টনমেন্টেও। পাকিস্তানীরা ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। বুটের আওয়াজে শিশু কেঁদে উঠলেও মা মুখ-চাপা দিয়ে বন্ধ করে দেয় কান্না। বাবা অফিসে যাওয়ার সময় বাইরে থেকে তালা দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে যায়—- যাতে যে কেউ বুঝবে যে এখানে কেউ থাকে না।

৩০ শে মার্চ, সকাল ৭:৩০ মিনিট। নাস্তার টেবিলে বসা বাবা-মা ( আমার শ্বশুড়-শ্বাশড়ি)। কেউ একজন আসলো বাইকে করে বাবার সাথে দেখা করতে। অতিথিপরায়ণ মা তাকে নাস্তা খাইয়ে ছাড়বেই না। বাঁধ সাধলো সেখানেই। বাইরে রাখা বাইক দেখেই বুঝে নিলো ভেতরে মানুষের অস্তিত্ব। ঢুকে পড়লো দুজন। বাবাকে বললো “ইমারজেন্সী রুগি আছে। এক্ষুনি চলুন।” দায়িত্ববান বাবা রুগীর কথা শুনেই ক্যাপটা হাতে তুলে নিলো। মা বললেন, “খাওয়াটা তো শেষ করো। ” “অসুবিধা নাই” বলেই বেরিয়ে পড়লেন বাবা। মাকে আমি পরবর্তীতে কখনো ভালোমত নাস্তা করতে দেখিনি। রুটি-সবজি-ডাল-ডিমভাজি বা মাংস দিয়ে কখনো নাস্তা করতেন না। শুকনো রুটি পেঁচিয়ে চায়ে চুবিয়ে খেতেন মা। আর কেমন যেন শুন্যে তাকিয়ে থাকতেন। কারো কখনো সাহস হয়নি ডিমভাজি বা সবজির বাটিটা এগিয়ে ধরতে তার সামনে।

মা সোহাগকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এভাবে কখনো তো মানুষটাকে হনহন করে হেঁটে যেতে দেখে নি। সোহাগ কেঁদে উঠলো। মা মুখ-চাপা দিলেন না—— বুক-চাপা দিয়ে রাখলেন। সোহাগকে শেষবারের মত একবার সোহাগও করতে পারলেন না বাবা। মা’র হাতে আর রান্না ওঠে না। কি যেন কী রান্না করা ছিল! মা শুধু কাঁচা আম দিয়ে একটু ডাল রান্না করলেন। প্রতিটি মুহূর্ত কাটে কলিংবেল বা ফোনের অপেক্ষায়। ফোনটা নস্ট হয়ে পড়ে রইল কি না সেটা চেক করে দেখে নেন বারবার। পাখির ডাকা-ডাকি আজ আর ভালো লাগে না—- একটি ডাকের অপেক্ষায় কাটে প্রতিটি ক্ষন।

দুপুরের দিকে ফোন আসে সব কাঁপিয়ে দিয়ে। মা দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরেন। “আমরা ভালো আছি, তোমরা ভালো থেকো” ——– বাবার কন্ঠ শুনতে পায় মা। যেন কোন দূর আকাশ থেকে শব্দগুলো মধুর মত ঝড়ে পড়ে মা’র কানে। মা “হ্যালো, হ্যালো, শুনছো, হ্যালো, হ্যালো…… ” ফোনটা কেটে যায়। মা নিথর দাঁড়িয়ে থাকেন ফোনটা ছুঁয়ে থেকেই। যেন বাবাকেই ছুঁয়ে আছেন।

মা’র চোখ গড়িয়ে জল পড়তে থাকে। অজানা আশংকায় বুক কেঁপে ওঠে। কাকে ফোন করবেন, কার সাথে কথা বলবেন, আর কাউকে ধরে নিয়ে গিয়েছেন কি না ——- কিছুই জানা হয় না।

আরো কিছু ফ্যামিলির সাথে মা আর সোহাগকেও আটকে রাখা হয় ইস্পাহানী স্কুলের একটি কক্ষে। খালেক আন্টি ( Nargis Akhter), মাহরাবের ফ্যামিলি, জামান আন্টি ( কিছুদিন আগেই মারা গেলেন) এবং আরো অনেকের সাথে দোতলার এক কক্ষে বসবাস। নিচতলায় মিলিটারীদের বুটের আওয়াজ সবসময়—- যেন বুকের উপর দিয়ে হাঁটছে ওরা। নিদারুন কষ্টে কাটে সেই দিনগুলি। খাওয়া নেই, পানি নেই। সোহাগ দুধ পায়না। মোটা, পোকাওয়ালা, গন্ধযুক্ত ভাত দেয় ওরা। টানা সাতদিন এভাবে এক কাপড়ে চলার পর তারা মুক্তি পায়। সোহাগের মামা গিয়ে নিয়ে আসে ওদের।27459533_1997483550502115_8222287778284130471_n

যেদিন বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন বিকেলেই নাকি অনেকেই ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনতে পেয়েছিল। ঠিক ঐ সময়টাই অন্যান্যদের সাথে বাবাকেও মেরে ফেলা হয়েছিল কি না—কেউ ই তা বলতে পারে না। অনেকদিন পর বাবার লাশ শনাক্ত করতে বড়মামা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট গিয়েছিলেন। সবার পচা-গলা লাশ। বাবা বেশ মোটা-সোটা ছিলেন, তাঁর কোমরের বেল্ট আর ইউনিফর্মের বুকের উপর চেপে বসা নেমপ্লেট দেখে শনাক্ত করেছিলেন —– এটাই বাবা।

“বাবাকে কি ওরা পিছমোড়া করে হাত বেঁধে রেখেছিল, যখন মেরেছিল তখন কি চোখ বেঁধে নিয়েছিল”——- মা, অসংখ্যবার নিজেকে জিজ্ঞাস করেন। তখন না জানি সোহাগের বাবার কেমন লগেছিল, না জানি তখন কার মুখটা ভেসে উঠেছিল………. কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন তিনি।
মা বলতেন, ” দেখো, একদিন সোহাগের বাবা ঠিক আসবে। এসে বলবে, এতদিন ওরা আমাকে আটকে রেখেছিল, তোমরা সবাই কেমন আছো, আমার খোকাটা কত্ত বড় হয়ে গেছে…….”। মাকে নাকি সোহাগ ছোটবেলায় জিজ্ঞাস করতো, “মা, আমার আব্বা কোথায়? মা মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিতেন, অনেক উপরে। ও বলতো, আব্বা ওখান থেকে আসে না কেন? মা বলতেন, অত বড় মই যে পৃথিবীতে নেইরে বাবা।”

৪৭ বছর পর আজও সকালে ঘুম থেকে উঠে তাঁরই ছেলে একই কথা বলে, “জানো, এখনও আমার মাঝে মাঝে মনেহয়, আব্বা হয়তো ফিরে আসবেন। এসে বলবেন, ওরা আমাকে আটকে রেখেছিল, তোদের মা কই……। আর আমরা বাবাকে চিনতেই পারবো না, হতভম্ব হয়ে যাবো।” ভিতরে কতটা কষ্ট জমা রেখে একজন বাবা, তার বাবা সম্পর্কে এরকম করে বলতে পারে, তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। কথাগুলো বলার সময় সোহাগ একবারও কাঁদেনা। যে পাকিস্তানি বাবা ( পশু???), আরেক বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেললো, আজ সেই বাবার ছেলে কি বুঝতে পারছে যে, বাবা হারানোর ব্যাথাটা কি রকম??????????

আজও সোহাগ বসে থাকে একটি মোটা, ভারী কন্ঠের অপেক্ষায় —- বাবা ডাকার আক্ষেপটা যে তার রয়েই গেল। আজও হঠাৎ হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে তড়িঘড়ি করে উঠে যায়—– কে যেন আসার আছে মনে ক’রে। আজও কুরিয়ারে চিঠি এলে দৌড়ে গিয়ে হাতে নিয়ে আগে প্রেরকের নাম দেখে। মা টা মারা গেল সেই অপেক্ষাগুলোই বুকে নিয়ে।

একটি মধুর ডাক তার আর কখনোই ডাকা হলো না। মাঝে মাঝে সোহাগের ইচ্ছা করে চিৎকার ক’রে ডেকে উঠতে…… বাবা……… বাবা গো….