মো.আনোয়ার হোসেন শাহীন,মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
গ্রামের হাট-বাজার, বটগাছের নিচে অথবা রাস্তার পাশে কাঠের পিড়িতে বসে খৌরকর্ম করছেন কয়েকজন মানুষ। চেহারায় বয়সের ছাপ।আছে দারিদ্রের ছাপও।তার পরও বাপ-দাদার ‌নরসুন্দরের পেশা আজও আঁকড়ে আছেন তারা।

জাগজমকপূর্ণ সেলূন সংস্কৃতির ঢেউ এখন শহর থেকে গ্রাম সবখানে। এর ফলে কোনঠাঁসা হয়ে পড়ছেন গ্রামাঞ্চলের  নরসুন্দরেরা। তবুও সাধারণ মানুষ আজও অবলীলায় ইটে বসে হাঁটুর কাছে এখনো মাথা পেতে দেন বলেই বেঁচে আছেন এরা । স্থানীয়ভাবে এরা পরামানিক কিংবা নাপিত বলেই বেশী পরিচিত।

মাটিতে বসে গাছতলার এই সেলুন এখন আর আগের মতো তেমন চোখে না পড়লেও হাটে হাটে মাঝেমধ্যেই দেখা যায় তাদের।
মাগুরার  উপজেলার, ইউনিয়ন, হাট-বাজার সবখানেই ছড়িয়ে গেছে সেলুন। রেক্সিন আর ফোমে  মোড়ানো গদিওয়ালা চেয়ার, বাঁধানো বাহারী আয়না, বিদ্যুৎ থাকলে মাথার উপরে  ঘুরতে থাকা ফ্যান, সস্তা ফোম-ক্রীম আর সুবাসিত রঙিন লোশন নিয়ে টিনের ঘর, টিনের ছাপড়া অথবা দেয়াল তোলা ঘরে চুল কাটার দোকানই সবার কাছে সেলুন। রুচি বদলের জোয়ারে এই সেলুনের কাছে অসহায় পরাজয় ঘটেছে প্রথাবন্দী দরিদ্র নরসুন্দরদের ।
পথের ধারে, বটের ছায়ায়, জলচৌকি অথবা ইটের আসনে বসে নরসুন্দরের হাঁটুর কাছে মাথা পেতে আছে খদ্দের, আর গভীর ধ্যানমগ্নতায় খদ্দেরের মাথায় ক্ষুর-কাঁচি চালাচ্ছেন নরসুন্দর এমন দৃশ্য দুর্লভ হলেও এখনো মাঝে মাঝে দেখা যায়।

তবে দিনের বেশীর ভাগ সময়ই হাত পা গুঁটিয়ে বসে থাকতে হয় খোলা আকাশের নীচে বসা ক্ষৌরকারদের। গ্রামের অভাবী কৃষক,দিন মজুর শ্রেনীর মানুষেরাই মূল ভরসা। এরা এখনো ময়লা তেলচিটে মার্কিন কাপড় অথবা গামছা গায়ে জড়িয়ে অবলীলায় মাথা নুইয়ে দেন নরসুন্দরের হাঁটুর কাছে। জল চৌকি অথবা ইটের আসনে বসেই সেরে নেন ৫ টাকার সেভ আর ১৫ টাকার চুল কাটার কাজ । লোশন না থাক ফিটকিরির ছোঁয়াই বা কম কি ? এদের বদৌলতে বউ-বাচ্চা নিয়ে বেঁচে আছে কার্তিক,সন্তোষ,বাদলরা ।

মাগুরার ইছাখাদা গ্রামের রমেশ পরামানিক মাগুরাবার্তাকে  জানান- একসময় গ্রামাঞ্চলে নরসুন্দরদের আদর,কদর আর ইজ্জতের কমতি ছিলনা । হাতের কাজ জানা থাকার কারণে অভাব এদের স্পর্শ করেনি তেমন একটা। দুই যুগ আগেও কাপড়ে জড়ানো ছোট্ট কাঠের বাক্স বগলে ফেলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুল-দাঁড়ি কামিয়ে দিয়ে আসার রেওয়াজ ছিল । বিনিময়ে মিলতো নগদ অর্থ অথবা পুরো বছরের পাওনা মিলতো নবান্নেরকালে, ধান-চালে। বদলে যাবার ক্ষমতা নেই বলেই অনেকে এখনো আছেন পৈত্রিক এ পেশায়। তবে খদ্দের খুবই কম, দিনে ৮/১০জনের বেশী না । এই আয়ে দিন চলে না। আগে বাড়ি-বাড়িতে ডাক পড়তো এখন আর কেউ ডাকে না। তাই দায় ঠেকে হাটে হাটে ছুটতে আর বাড়ির কাছের বাজারেই বসতে হয় প্রতিদিন।

স্বাধীনতার ১ যুগ পরেও এমন কোন গ্রাম ছিলনা যেখানে মিলতো না ২/৪ ঘড় শীল পরিবার । এখন ১০ গ্রাম খুঁজেও এদের দেখা পাওয়া মুষ্কিল । কেউ বা পেটের দায়ে দেশত্যাগী হয়েছেন,কেউবা গ্রাম ছেড়ে শিকড় মেলেছেন শহরে। পেশার বদলও ঘটেছে যথেষ্ট । খুব দেরী নেই রুচি বদলের হাওয়ায় বটতলা, হাট খোলা,থেকে হারিয়ে যাবেন এঁরাও।

সদর উপজেলার পরিতোষ শীল বলেন, ‍সেলূনের ব্যবসা এখনো জমজমাট। তবে গাছ তলায় নয়। সাজানো-গোছানো আলোকোজ্জল কক্ষে। তাদের লোকজন সেলুনের কর্মচারি হিসেবে কাজ করলেও, ব্যবসা অর্থশালীদের হাতে। তারপরও যুগযুগ ধরে বাপ-দাদা পেশা আঁকড়ে আছেন তারা।

মাগুরার বিশিষ্ট সংস্কৃতিক কর্মী এটিএম আনিসুর রহমান মাগুরাবার্তাকে জানান, প্রাচীণকাল থেকে নরসুন্দরের পেশা সমাদৃত। বর্তমানে পেশার ধরন বদলালেও উপযোগিতা কমেনি। তবে গাছতলায় বসে নরসুন্দরের হাটুতে মাথা গুজে খৌরকর্মের কথা মনে পড়লে শৈশবরে স্মৃতেই ভেসে উঠে। নানা কারণে এ পেশার লোক হারিয়ে যেতে বসেছে।এদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া উচিত।