শাহিনুর আহমেদ, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও প্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক এবং বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ এর পরিচালক ফজলুল হক-এর মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হলো ২৬ অক্টোবর। ফজলুল হকের স্মৃতির স্মরণে ২০০৪ সাল থেকে ‘ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার’ প্রর্বতন করেন ফজলুল হক স্মৃতি কমিটির পক্ষে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন। এ বছর এ পুরস্কার পেয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালনায় আবদুল লতিফ বাচ্চু এবং চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় নরেশ ভূঁইয়া। এ উপলক্ষে গতকাল/২৬ অক্টোবর দুপুরে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন অভিনেতা ও নির্দেশক মামুনুর রশিদ। সভাপতিত্ব করেন কেকা ফেরদৌসী। অনুষ্ঠানের শুরুতে ফজলুল হককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মোরশেদুল ইসলাম, আলী ইমাম, আজিজুর রহমান, নুরুল আলম বাবু, আল মনসুর, আবু সায়ীদ, কনা রেজা প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন মৌসুমী বড়ুয়া। এরপর অতিথিরা পুরস্কার প্রাপ্তদের হাতে সম্মানা ক্রেস্ট ও অর্থমূল্য তুলে দেন। পুরস্কার প্রাপ্তদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান ফজলুল হক পরিবারের সদস্য ও চ্যানেল আই এর পরিচালক মুকিত মজুমদার বাবু। অনুষ্ঠানে দেখানো হয় ফজরুল হকের জীবন ও কর্ম নিয়ে নির্মিত ‘সম্মুখযাত্রী’ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র। প্রামাণ্যচিত্রটি পরিচালনা করেছেন শহিদুল আলম সাচ্চু। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফজলুল হক পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও বিভিন্ন অঙ্গণের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

আবদুল লতিফ বাচ্চু
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গণে সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অন্যতম আবদুল লতিফ বাচ্চু। পাশাপাশি চলচ্চিত্র পরিচালনায়ও অর্জন করেছেন সুনাম ও সম্মান। আবদুল লতিফ বাচ্চু ১৯৪২ সালের ৯ জানুয়ারি রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শাহজামাল তালুকদার ও মাম আমিনা বেগমের সন্তান তিনি। পড়লেখা করেন রাজশাহীতে।

নরেশ ভূঁইয়া
নোয়াখালীর এক ব্যবসায়ী পরিবারে ১৯৫২ সালে জন্ম নরেশ ভূঁইয়ার। বেড়ে উঠা এবং পড়ালেখা একই জেলার চৌমুহনীতে। ১৯৭২ সালে সংশ্লিষ্ট হন সেই সময়ের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ পত্রিকায়। একটানা ৩৩ বছর একই পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন। প্রদায়ক হিসেবে কাজ করেছেন সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী এবং পাক্ষিক আনন্দ বিচিত্রায়।

ফজলুল হক জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের ২৬ মে বগুড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ফজলুল হক ছিলেন এ দেশের প্রথম সিনেমা বিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক ও প্রকাশক। পঞ্চাশের দশকে এদেশে সিনেমা শিল্পের যাত্রা শুরুর আগেরই সিনে সাংবাদিকতা বা চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ রীতিমতো দুঃসাহসিক কাজ ছিল। এখনকার চলচ্চিত্রশিল্প বা অসংখ্য পত্র-পত্রিকার যুগে সেই সময়ের এই উদ্যোগ সম্পর্কে কল্পনাও করাও কষ্টকর। ফজলুল হক সেই অসাধান্য কাজটি করেছিলেন। সেই দিন থেকে ফজলুল হককে এদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার জনক বলা হয়। ১৯৫০ সালে বগুড়া থেকে সিনেমা পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকাশনা ঢাকায় স্থানান্তর হয়। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো ২, এসি রায় রোড ঢাকা থেকে। পত্রিকাটির সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫৯ সালে। তৎকালীন সময়ের অত্যন্ত মানসম্পন্ন ও জনপ্রিয় পত্রিকা ‘সিনেমা’।
ষাটের দশকের শুরুতে ফজলুল হক ‘প্রেসিডেন্ট’ নামে একটি শিশুতোষ সিনেমা তৈরি করেছিলেন যা পাকিস্তান আমলে পুরস্কৃতও হয়েছিল। অনেকে হয়তো জানেন না, ‘প্রেসিডেন্ট’ ছবিতে শিশুনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন আজকের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর। ‘প্রেসিডেন্ট’ ছবিটি যখন নির্মিত হয় তখন ঢাকায় প্রযোজিত সিনেমার সংখ্যা মাত্র কয়েকটি। পরে তিনি ‘উত্তরণ’ নামে আরো একটি সিনেমা পরিচালনা করেন। পত্রিকা সম্পাদনা বা চলচ্চিত্র পরিচালনা কোনোটাতেই তিনি থেমে থাকেননি। পরে অন্যান্য ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। একসময় তিনি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যান। এদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের একেবারে সূচনা পর্বে ফজলুল হকের অবদান স্মরণীয়। তাঁর অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘ফজলুল হক স্মৃতি কমিটি’ প্রতি বছর একজন চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও সেরা চলচ্চিত্রের পরিচালককে পুরস্কৃত করে আসছে।

২০০৪ থেকে প্রবর্তিত এই পুরস্কার ইতিমধ্যে পেয়েছে ফজল শাহাবুদ্দীন, আহমদ জামান চৌধুরী, চাষী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদ, সাইদুল আনাম টুটুল, রফিকুজ্জামান, সুভাষ দত্ত, হীরেন দে, আবদুর রহমান, গোলাম রাব্বানী বিপ্লব, সৈয়দ শামসুল হক, আমজাদ হোসেন, চিন্ময় মৃৎসুদ্দী, মোরশেদুল ইসলাম, ই আর খান, অনুপম হায়াৎ, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, গোলাম সারওয়ার, নায়করাজ রাজ্জাক, রেজানুর রহমান, সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী, আরেফিন বাদল, মাসুদ পারভেজ, শহীদুল হক খান, আজিজুর রহমান ও মোস্তফা জব্বার। ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার ২০১৭ পেয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালনায় আবদুল লতিফ বাচ্চু এবং চিত্র সাংবাদিকতায় নরেশ ভূঁইয়া।

উল্লেখ্য, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন তার সহধর্মিণী। জ্যেষ্ঠপুত্র ফরিদুর রেজা সাগর বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক ও টিভি ব্যক্তিত্ব এবং চ্যানেল আই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ছোট ছেলে ফরহাদুর রেজা প্রবাল বাংলাদেশ টেলিভিশনের এক সময়ের জনপ্রিয় উপস্থাপক ও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী স্থপতি, বড় মেয়ে কেকা ফেরদৌসী বিশিষ্ট রন্ধনবিদ ও ছোট মেয়ে ফারহানা মাহমুদ কাকলী একজন সুগৃহিনী।