পরেশ কান্তি সাহা, মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও গবেষক
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে চালিয়েছে গণহত্যা। একাজে উৎসাহিত এবং সহযোগিতা করেছে এদেশের রাজাকার। ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা। দীর্ঘসময় অতিবাহিতের পর প্রধান প্রধান রাজাকারদের বিচার হলেও বিচার হয়নি পাকিস্তানের নৃশংসকারী গণহত্যাকারীদের। এমন কি সেই অপকর্মের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি পাকিস্তান। এমনই একটা গণহত্যা ঘটিয়েছিল মাশালিয়ায়।
মাশালিয়া গ্রামটি হলো মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার উত্তর পশ্চিম কর্ণারে। শৈলকূপা থানার সীমান্তে। মাগুরা শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে, ওয়াপদা ক্যানেলের পাশে। লাঙ্গলবাঁধ থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণে।
শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন আকবর হোসেন মিয়া। পশ্চিম পাকিস্তানে এয়ারফোর্সে চাকরি করতেন কিন্তু মতের মিল না হওয়ায় চাকরি ছেড়ে চলে আসেন। ৩নং শ্রীকোল ইউনিয়নে ২৩ বছর চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে আকবর বাহিনী হিসাবে পরিচিত ছিল। আর সরকার কর্তৃক স্বীকৃত হয় শ্রীপুর বাহিনী। এই বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা ছিল ভিত-সন্ত্রস্ত।
২৭ অক্টোবর বুধবার। পাকিস্তানি সেনারা কুষ্টিয়া থেকে লাঙ্গলবাঁধে গাড়ি রেখে শ্রীপুরে এসেছিল। যেহেতু লাঙ্গলবাঁধে গাড়ি রেখে এসেছিল, সেহেতু লাঙ্গলবাঁধে ফিরে যাবে- একথাটা অধিনায়ক আকবর হোসেন বুঝতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা ক্যানেল দিয়ে ফিরছিল। অধিনায়ক আকবর হোসেনের দল গোয়ালপাড়া-নবগ্রাম-চন্ডীখালী হয়ে সোজাপথে মাশালিয়ায় পৌঁছান। এলএমজি ম্যান শফিউদ্দিন জোয়ার্দার (খামারপাড়া), ইপিআর আব্দুল মান্নান (বালিয়াডাঙ্গা) ও নবগ্রামের এলাহী রহমানকে মাশালিয়া ব্রীজের কাছে পাঠান। মুক্তিযোদ্ধাদের দলে ছিলেন অধিনায়কসহ ১৫ জন।
অধিনায়ক আকবর হোসেন মাশালিয়া গ্রামেই একটু দূরে গ্রাম সরকার আব্দুস সামাদের বাড়ীতে অবস্থান করেন। এলএমজিম্যান শফিউদ্দীন জোয়ার্দ্দার, ইপিআর আব্দুল মান্নান ও নবগ্রামের এলাহী রহমান মাশালিয়া গ্রামে ক্যানালের পূর্ব পাশের খাদে অবস্থান নেন। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা ২০ গজ পিছনে মসজিদের দক্ষিণ পূর্ব পাশে থাকেন।
পাকিস্তানি সেনারা ২০/২৫ হাত দুরে জোড়ায় জোড়ায় লাঙ্গলবাঁধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। একই গ্রামের গণ শহিদ সুরোত আলী শেখের ছেলে প্রত্যক্ষদর্শী মোঃ রওশন আলী শেখ জানান যে, তখন তার বয়স ১৩/১৪ বছর। কৌতুহল বসত হেঁটে যাওয়া পাকিস্তানি সেনাদের গুনেছিলেন। সংখ্যা ছিল ৮৭ জন। পাকিস্তানি সেনারা হেঁটে যেতে যেতে সামনের দিকটা লাঙ্গলবাঁধের বড় ক্যানেল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। শেষের দিকটা অর্থাৎ পিছন দিকটা মাশালিয়া ব্রীজের কাছে পৌঁছালেই এলাহী রহমান এলএমজি ম্যানদের ইঙ্গিত দেন গুলিকরার। সঙ্গে সঙ্গে এলাহী রহমানও গুলি ছোড়েন। ওই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ১ জন অফিসার, ৪ জন সৈনিক ও ১ জন রাজাকার নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনারাও পজিসন নিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। এগিয়ে যাওয়া সেনারা ক্রলিং করে এগিয়ে আসতে থাকে। ভিমরুলের চাকে ঢিল ছুড়লে যে পরিস্থিতি হয়, ঠিক তেমনটি হলো। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কোন গুলির শব্দ না আসায় পাকিস্তানি সেনারাও গুলি ছোড়া বন্ধ করে দেয়। তখন তারা ক্যানেলের ব্রীজ পাড় হয়ে পূর্ব পাশে যায়। মসজিদের পাশের বাড়ী সুরোত আলী শেখকে ধরে ফেলে। মসজিদের ইমাম ইয়াকুব বিশ্বাস মসজিদের ভিতরেই ছিলেন। তাকেও ধরে ব্রীজ পর্যন্ত নিয়ে যায়।
তাকে জিজ্ঞেস করে- তুম মুক্তি হায়?
– না, আমি মসজিদের ইমাম।
– তুম ঠারো। মুক্তি কেদার গিয়া? তুম মালুম হায়? সাচ্চা বাত বাতাও। তুমকো কই ডর নেহি হায়।
তখন মসজিদের ইমাম ইয়াকুব বিশ্বাস মুক্তিবাহিনী যে দিকে গেছে, সেটা না দেখিয়ে বিপরীত দিকে হাত ইশারা করে দেখিয়ে দেন। ব্রীজের কাছে তাকে ছেড়ে দেয়। সেনারা ক্যানেলের ব্রীজ পাড় হয়ে যেতে থাকে। একটু এগিয়ে দেখে শেখপাড়া ক্যানেলের পাশে ২টা বাঙ্কার এবং তার মধ্যে বেশ কয়েকজন যুবক অবস্থান করছে। প্রকৃতপক্ষে গ্রামবাসীরা নিজেদের রক্ষার জন্যই ঐ বাঙ্কার কেটেছিল। মুক্তিবাহিনী ভেবে ব্যায়ানেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে। সুরোত আলীসহ ১৩ জন নিরপরাধ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে আসে পাশের ২৫/৩০ টি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে চলে যায় লাঙ্গলবাঁধে। যাবার সময় পাকিস্তানি সেনাদের লাশগুলো নিয়ে মালিথিয়া বর্তমানে যেখানে বাসষ্ট্যান্ড, তার পাশে মাটিচাপা দেয়। চলে যায় কুষ্টিয়ার দিকে।
পাকিস্তানি সেনারা স্থান ত্যাগ করার পর অধিনায়ক আকবর হোসেন উপ-অধিনায়ক মোল্লা নবুয়ত আলীকে খবর পাঠান। তাঁরা এসে চেয়ারম্যান শাহবুদ্দীন এবং মুক্তাদির বিশ্বাস (পরে উপজেলা চেয়ারম্যান) এর সহায়তায় লাঙ্গলবাঁধ বাজার থেকে নতুন কাপড় কিনে নিহত ১৩ জনকে নিজনিজ বাড়ীতে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেন। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ত্রিশ লক্ষ শহিদের পুঞ্জিভুত রক্তই ঠাঁই নেয় জাতীয় পতাকার হৃদয়ে।

গণ-শহিদদের নামের তালিকা ঃ
স্থান    ঃ    মাশালিয়া-মালিথীয়া (শেখপাড়া)
তারিখ    ঃ    ২৭ অক্টোবর ১৯৭১, বুধবার

ক্রঃ নং    নাম    পিতার নাম    ঠিকানা
০১    খোরশেদ মোল্লা  –  বদন মোল্লা    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
০২    হবিবর মোল্লা   – জহির মোল্লা    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
০৩    সৈয়দ আলী মোল্লা  –  তরাজতুল্লাহ    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
০৪    মোসলেম শেখ   – মুনসুক শেখ    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
০৫    আব্দুল জলিল   – মুনসুক শেখ    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
০৬    ইসমাইল শেখ   – বানু শেখ    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
০৭    মকছেদ শেখ    হেরাজতুল্লাহ    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
০৮    দুধ মল্লিক    খলিল উদ্দিন    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
০৯    অহেদ শেখ   – জামাল শেখ    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
১০    আনসার শেখ –   জামাল শেখ    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
১১    উজ্জ্বল শেখ    -আসরাফ শেখ    মালিথীয়া (শেখপাড়া), ধলহরা ইউনিয়ন, শৈলকূপা, ঝিনাইদহ
১২    সুরত আলী    -হারান বয়াতী    মাশালিয়া, ১নং গয়েশপুর ইউনিয়ন, শ্রীপুর, মাগুরা
১৩    একেল উদ্দিন  –  বাগু মন্ডল    সাওরাইল, সাওরাইল ইউপি, পাংশা, রাজবাড়ী (বেড়াতে এসেছিলেন)

তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা ঃ অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, কবি ও গল্পকার মনোজিৎ কুমার দাস, মুক্তিযোদ্ধা এলাহী রহমান (নবগ্রাম), মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ বিশ্বাস, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, গয়েশপুর ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দীন জোয়ার্দার (খামারপাড়া), প্রত্যক্ষদর্শী গণশহিদ সুরোত আলী শেখের ছেলে মোঃ রওশন শেখ (মাশালিয়া) ও অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক ইসরাইল হোসেন (চন্ডিখালি)।