ওয়েব ডেস্ক, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যম দুয়ারে পড়লো কাঁটা
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা
আজ থেকে আমার ভাই,
যম দুয়ারে তিতা।

ভাইফোঁটা কোনো প্রচলিত পূজা-পার্বণ নয়। বাঙ্গালীর ঘরে ‘ভাইফোঁটা’ হচ্ছে সবচেয়ে আনন্দময়, নির্মল একটি পর্ব। ভাই-বোনের মধ্যেকার অনিন্দ্যসুন্দর সম্পর্ক ঘিরেই প্রচলিত হয়েছে এই উৎসবটি। ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় ঈশ্বরের কাছে বোনের আকুতি, ভাইয়ের সাফল্য, দীর্ঘায়ু লাভের জন্য বোনের প্রার্থনাই ‘ভাইফোঁটা’ কে মহিমান্বিত করেছে।

পঞ্জিকার হিসেব মতে কালীপূজার দুই দিন পরে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠিত হয়। আজ মঙ্গলবার ছিল ভ্রাতিৃদ্বিতীয়া। ভাইফোঁটার ধর্মীয় গুরুত্ব অপেক্ষা সামাজিক ও পারিবারিক গুরুত্ব অনেক বেশি, যেখানে ভাই-বোনের মধ্যেকার প্রীতি ও ভালোবাসার স্বর্গীয় সম্পর্কটিই মূখ্য। ভাই বোন দুজনেই বছরের এই একটি দিনের অপেক্ষায় থাকে।

হিন্দু সমাজে প্রচলিত লোকউৎসব ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। এর পিছনে একটি পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। কাহিনীটি অনেকটা এ রকম; কোনো এক কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে যমুনা দেবী তার ভাই যমের পূজা করেন এবং পুণ্য প্রভাবে যমদেব অমরত্ব লাভ করেন। এ কারণে এ তিথির নামান্তর হয় যমদ্বিতীয়া। যমুনার পূজার ফলে ভাই যমের এই অমরত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু রমণীরাও ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় সামান্য ভিন্ন রীতিতে এ উৎসব পালন শুরু করে।

বর্তমানে বোন উপবাস থেকে কার্তিক মাসের দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইয়ের কপালে বাঁহাতের কড়ে আঙ্গুল দিয়ে চন্দনের (ক্ষেত্র বিশেষে ঘি, কাজল বা দৈ-ও হতে পারে) ফোঁটা দিয়ে হাতে রাখি পরিয়ে দেয়, আর তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করে বলে, ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যমের দুয়ারে পড়ল কাটা।’

সময়ের পরির্বতনের সাথে সাখে এই উৎসবের নাম হয় ‘ভাই ফোঁটা’। এ উৎসব উপলক্ষে বোন ভাইকে নতুন জামা-কাপড় কিংবা অন্যান্য উপহার সামগ্রী দেয় এবং ভাইও বোনকে প্রত্যুপহার দেয়। বাড়িতে বাড়িতে এই দিন বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়।

14956469_982733438519828_3467853777381959790_n

ভাই ফোঁটার দিন ভাইয়ের হতে রাখি পরিয়ে দেয়ার অন্তরালে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সম্পৃক্ততা আছে। ১৩১২ বঙ্গাব্দ (১৯০৫ সাল) বঙ্গভঙ্গ আইন পাস হলে তার প্রতিবাদ এবং সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে ৩০ আশ্বিন দুই বঙ্গের লোকদের হাতে হলুদ সুতার রাখি পরিয়ে দেয়া হয় যা রাখিবন্ধন উৎসব নামে পরিচিতি লাভ করে।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় সারা বাংলায় ‘রাখী বন্ধন’ উৎসব হয়েছিল। কবিগুরু কোনো আন্দোলনে সরাসরি যোগ না দিলেও ‘রাখীবন্ধন’ উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। সেদিন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, মারাঠির মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সকলেই ভাই, প্রতিটি ঘরে ঘরে ছিল স্নেহময়ী বোন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়, কত অচেনা মায়ের ছেলেকে ‘ভাইয়ের স্নেহে’ শত্রুর আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছে বাংলার বোনেরা। এভাবেই যুগে যুগে ভাই-বোনের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে।

ঋকবেদ অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডদাতা যম ও তাঁর বোন যমুনা হচ্ছে সূর্য্যের যমজ সন্তান, অর্থাৎ তারা যমজ ভাই বোন। বড় হয়ে তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে থাকতেন। দীর্ঘকাল অদর্শনে থেকে বোন যমুনার খুব ইচ্ছে হলো ভাই যমকে একটু দেখার। ভাইকে নিমন্ত্রণ করতেই ভাই যমরাজ বোনের বাড়ীতে এসে উপস্থিত। ভাইকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন শেষে ভাইয়ের জন্য মন ব্যাকুল হতেই বোন যমুনা ভাইয়ের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে প্রার্থনা করেন, ভাই যমরাজ খুব প্রীত হন বোনের এই আকুলতা দেখে।

বোনকে নিশ্চিন্ত করতে বোনের ডাক পেলেই আবার আসার প্রতিশ্রুতি দেন। যমুনা তার ভাইয়ের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে খুশীতে আনন্দাশ্রু ফেলেন। সেই থেকেই ভাইয়ের মঙ্গল কামনা উৎসবের প্রচলন। সেই থেকেই ভাইয়ের কল্যাণে অনুষ্ঠিত পর্বটি বিভিন্ন নামে পরিচিত।

বাঙ্গালীদের মাঝে ভাইফোঁটা, নেপালে ‘ভাই টীকা’ অথবা ভারতের নানা প্রদেশে ‘ভাইদুজ’ নামে পালিত হয়। রাখীবন্ধনও ভাইফোঁটার আরেক সংস্করণ।