মো: আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
দরিদ্র মামা-বাবার ঘর আলো করেছে আফেরোজা। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে গ্রামে। তাকে একনজর দেখতে বাড়িতে ভিড় করছেন আশপাশের গ্রামের নারী পুরুষ শিশুরা।
এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চতুর্থ বিষয়  ছাড়াই জিপিএ ৫ পেয়েছে আফরোজা আক্তার লিমা। সে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের আর.এস.কে.এইচ ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয়। আফরোজার বাড়ি উপজেলা সদরের গোপালপুর গ্রামে। তবে দারিদ্র কি তবে হারিয়ে দেবে আফরোজাকে? আফরোজার উচ্চ শিক্ষার জন্য সমাজের বিত্তবানদের সহায়তা চেয়েছেন স্বজনরা।

অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। দুবেলা ঠিকমতো খাবার জুটেনি। সংসারের খরচ জোগাতে বাবা শহীদুল ইসলাামকে অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতে হয়। লেখাপড়ার প্রতি প্রচ- আগ্রহ ছিল ওর। শুধু অধ্যবসায় ও ইচ্ছাশক্তির জোরে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। অভাব আর নানা সীমাবদ্ধতাকে ডিঙিয়ে অদম্য কিশোরী আফরোজার কৃতিত্বের গল্প এখন সবার মুখে মুখে।
বাবা শহীদুল ইসলাম বর্গা চাষী। পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া বসতবাড়ি ছাড়া কোন জমি নেই। বাড়িতে ঘর বলতে ছোট একটি দুই চালা টিনের ঘর। নাছিমা বেগমের দুই মেয়ের মধ্যে আফরোজা বড়।
আফরোজার মা নাছিমা বেগম বলেন, ‘ অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বিয়ে হয়ে যায়। ইচ্ছা থাকলেও পড়তে পারেন নি। এখন মেয়েকে পড়াতে চান । এত কষ্ট সত্ত্বেও সে ভালো ফল করায় আমরা খুব খুশি।’
আফরোজা ভালো ফল করার পরও মেয়ের উচ্চশিক্ষা নিয়ে সংশয়ে আছেন । তিনি বলেন, ‘আমার অভাবের সংসার। এখন পড়াার খরচ আরও বাড়বে। আমি কীভাবে মেয়ের আশা পূরণ করব।’
আফরোজার বাবা মো. শহীদুল ইসলাম জানান, ‘মৌসুমি কিছু ফসল বিক্রির টাকায় সংসারই চলতে চায় না। তার উপর মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। মেয়ে পরীক্ষায় ভালো করেছে এতে তাদের দুশ্চিন্তা আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়ের কলেজ ভর্তি পড়াশুনার খরচ কীভাবে  জোগাড় করবেন তা ভেবে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।’
বাবার এই কষ্ট বুঝতে সমস্যা হয় না আফরোজার। তবে তার ভেতরে বড় কিছু করার স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে। লেখাপড়া ছাড়া এই স্বপ্নপূরণের আর কোনো পথও যে জানা নেই তার!
আফরোজাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট একটি টিনের ঘরে তাদের বসবাস। ঘরের চালের টিনে অসংখ্য ছিদ্র। বাড়ির ছোট উঠানে গ্রামের নানা বয়েসি নারী পুরুষ ও শিশুদের ভীড়। তারা সাফল্যের খবর শুনে আফরোজাকে দেখতে এসেছেন।
তাদের একজন সিঙ্গাপুর প্রবাসী রবিউল ইসলাম মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন,‘আফরোজার হার না মানা এই মানসিকতা ও পরিশ্রম বৃথা যায়নি। ইচ্ছা শক্তি তাকে বহুদূূর নিয়ে যাবে।’
আফরোজা জানায়, সকাল সাতটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরের বিদ্যালয়ে যেতে হতো। সারা দিন বিদ্যালয়ের ক্লাস করে বিকেল চারটায় বাড়ি ফিরে টিউশনি করতে হতো। একদিকে সংসারের খরচ, অন্যদিকে পড়াশোনার খরচ বাবা মেটাতে পারতেন না। পরিবারে আর্থিক অনটন রয়েছে ঠিকই, তবে আমি কখনোই স্বপ্ন থেকে পিছপা হইনি। তাই সাফল্য এসেছে।’
প্রতিদিন ৭/৮ঘন্টা পড়ালেখা করত আফরোজা। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসিতেও টেলেন্টপুলে বৃত্তিসহ জিপিএ-৫ পায় সে। বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও সে সামনের সারিতে থাকত। বিতর্ক ও উপস্থিত বক্তৃতা তার প্রিয় বিষয়।
পড়ালেখার বিষয়ে নানা ভাবে সহযোগিতার জন্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ,কে.এম নাসিরুল ইসলাম, সহকারি প্রধান শিক্ষক শ্রী স্বপন কুমার চক্রবর্তী, বিজ্ঞান শিক্ষক কামরুজ্জামান সুইট ও ইংরেজি শিক্ষক আকবর হাসমত হায়দার স্যারের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করে।
ভালো একটি কলেজে ভর্তি হতে পারাটাই আফরোজার এখন প্রধান লক্ষ্য। ভবিষ্যতে বুয়েটে ভর্তি হয়ে প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা তার।
আফরোজার এই সাফল্য অন্যদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। যদি মনে প্র্রবল ইচ্ছা থাকে তাহলে দারিদ্র্য কখনোই বাধা হতে পারে না বলে মনে করেন মহম্মদপুর উপজেলা সদরের আর.এস.কে.এইচ ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক এ.কে.এম.নাসিরুল ইসলাম। আফরোজার সহযোগিতায় এগিয়ে আসার জন্য তিনি সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহবান জানান।’
০৬ মে ২০১৭, মহম্মদপুর, মাগুরা