বয়স মাত্র ৪ বছর। কিন্তু চেহারায় আশিতিপর বৃদ্ধের ছাপ। বয়সের ভারে নুহ্য মানুষের মতই নানা শারীরিক জটিলতা নিয়ে অজ্ঞাত রোগে ভূগে বড় হচ্ছে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের খালিয়া গ্রামের বায়েজিদ নামে এক শিশু। পরিবারের একমাত্র শিশুর এমন অদ্ভত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় অসহনীয় দিন কাটাচ্ছেন ওই শিশুটির পরিবারের সদস্যরা। বায়েজিদ ওই গ্রামের লাভলু শিকদার ও তৃপ্তি খাতুনের একমাত্র ছেলে। ছেলের চিকিৎসা করাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে দরিদ্র ওই পরিবারটি। নিস্পাপ এই শিশুটিকে বাঁচাতে সমাজের সকলের সহায়তা চেয়েছেন তারা।
সরেজমিন খালিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে- ৪ বছরের বায়েজিদের চেহারায় শিশুর সারল্যে। মায়া জড়ানো মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। কিন্তু দেখলে যে কেউ চমকে উঠেন। তার চেহারায় বৃদ্ধ মানুষের ছাপ। আশি বছরের পৌড়ের মতো মুখ পেটসহ শরীরের চামড়া কুচকে ঝুলে আছে। দেখলে মনে হবে অবিকল একজন বৃদ্ধ মানুষ বসে আছে।
বায়েজিদের দাদা হাসেম আলী শিকদার বলেন, শিশুটি কিছুটা অন্য রকমের চেহারা নিয়েই জন্ম নেয়। এ নিয়ে এলাকার লোকে নানা কথা রটাতো । অনেকে ভয়ে তার কাছে আসতো না। আস্তে আস্তে সে বড় হতে থাকলে তার চেহারায় বৃদ্ধ মানুষের ভাব চলে আসে। দিন যাচ্ছে তার এ সমস্যা বাড়ছে।
তিনি জানান- সবাই যখন শিশুটিকে ফেলে দূরে সরে যেতে লাগলো তখন পরম মমতায় সন্তান বায়েজিদকে লালন পালন করতে লাগলেন মা তৃপ্তি খাতুন। কিন্তু অন্য দশটি শিশুর চেয়ে বায়েজিদ সম্পূর্ণ আলাদা।
বায়েজিদের মা তৃপ্তি খাতুন বলেন, স্বাভাবিকভাবে শিশু ১০ মাসে হাটা শিখলেও বায়েজিদ সাড়ে তিন বছরে হাটতে শিখেছে। আবার তিনমাস বয়সে তার সবগুলো দাঁত উঠে গেছে। এছাড়া সে স্বাভাবিক চলাফেরা ও খাওয়া দাওয়া করতে পারে। শৈশবে ভয়ে সন্তানের বিকৃত চেহারা দেখে কেউ কাছে আসত না। আমি তাকে পরম যত্নে বড় করছি।
বায়েজিদের বাবা লাভলু শিকদার বলেন, অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি ৩-৪ লাখ টাকা ব্যয় করেছি। কোন ডাক্তারই অসুখ ধরতে পারেননি। অনেক কষ্টে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে কয়েক জায়গায় চিকিৎসা করিয়েও কোন ফল পাইনি। চিকিৎসকেরা বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যা তার পক্ষে সম্ভব নয়। নিরুপায় হয়েই সব কাজ ফেলে তার আদরের ধন বয়ে বেড়ান তিনি। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এই শিশুর চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়।
তিনি জানান- নিজের সামান্য জমিতে কৃষি কাজ আর মৌসুমি ক্ষুদ্র ব্যবসা করে চলে তাদের সংসার। ঘর আলো করে প্রথম সন্তান বায়েজিদের জন্ম হয়। জন্মের সময় সে অন্য দশটি শিশুর মতো স্বাভাবিক ছিল না । আট মাস বয়স থেকেই সে আর উঠতে পারত না। এমনকি হামাগুড়ি দিতেও পারত না। চিকিৎসকদের মতে তার এই জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে পারলে ভাল হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে তার পরিবারের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। সমাজের বিত্তবানরা সহায়তা করলে তিনি ছেলেকে উন্নত চিকিৎসা করাতে চান।
মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মোকসেদুল মোমিন জানান, একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি অনেকটাই যেমন জিনগত ও পরিবেশগত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তেমনি নির্ভর করে তার সার্বিক সুস্থতা ও হরমোনের ওঠানামার ওপর।
এছাড়া শৈশবে কোন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, যেমন কিডনি বা ফুসফুসের রোগ, অপুষ্টি ইত্যাদি কারণে শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীরের প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি যে হরমোনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যে থাইরয়েড ও গ্রোথ হরমন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই হরমোনগুলোর অভাবে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি থমকে যেতে পারে বা ধীরে হতে পারে। নানা ধরনের জেনেটিক সমস্যায় এমন হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে টার্নার বা ডাউনস সিনড্রোম। এ রোগের চিকিৎসা থকলেও জটিল সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল’।
মহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. হামিদ মিয়া জানান,‘কোন পিতার কাছেই সন্তানের এই অবস্থা কারও জন্য সুখকর নয়। দরিদ্র এই পিতার সন্তানের চিকিৎসার জন্য বিত্তবান লোকজন এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।’