বিশেষ স্বাক্ষাতকার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৮ নং সাব-সেক্টর কমান্ডার, বর্তমানে মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অবঃ) এটিএম আবদুল ওয়াহ্হাব এমপি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে এ দেশের স্বাধীনতার জন্য বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবে যশোর সেনানিবাসে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজের জীবনকে বাজি রেখে তার অনুগত বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেন।

সেনানিবাস থেকে বেড়িয়ে তিনি প্রথমে যশোর শহরে অভিযান পরিচালনা করেন। এ অঞ্চলে তাঁর নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে একের পর এক যুদ্ধ পরিচালনা করে পাকিস্তানী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন শেষে ২০০২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

বর্তমানে তিনি মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে জনসেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সম্প্রতি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার টুপিপাড়ায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে একান্ত আলাপচারিতা হয় মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় নিয়ে। তার এ একান্ত সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন সাংবাদিক মুসাফির নজরুল।

প্রশ্ন : সেনাবাহিনীতে আপনি কত সালে কোথায় যোগদান করেন?
উত্তর : ১৯৬৮ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানের কোয়েটাতে সেনাবাহিনীর কমিশন পদে যোগদান করি।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে আপনি কোথায় কোথায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন ?
উত্তর : মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ৩০শে মার্চ আমি হিসেবে যশোর সেনানিবাসে ক্যাপ্টেন দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় বেরিয়ে এসে যশোর শহরে কিছু অভিযান চালাই। তার পরপরই  মাগুরায় চলে আসি। পরে আমি ঝিনাইদহ-মাগুরার মাঝখানে আলমখালিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। পরে আমি ভারতে চলে যাই। ওখানে গিয়ে আমি ৮ নং সাব-সেক্টরের দায়িত্ব পালন করি। প্রথমে আমি ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ চালাই। যশোরে আক্রমণ চালাই, ওই আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৯ জন সদস্য নিহত হয়। এরপরে আবার কল্যাণীতে সেক্টরে চলে আসি। তারপর সাতক্ষিরার বুদাডাঙ্গায় আমাকে পাঠনো হয়। ওখানে আমি অনেকগুলো অপারেশন করি। বরিশাল বিওপিতে আক্রমণ করি এবং ওখানে ৯ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। তারপর আমি সেক্টরে চলে আসি। সেখান থেকে আক্রমণ করার চেষ্টা করি। তারপরে আমি বানপুরে অবস্থান করি এবং একটা কোম্পানী ফর্ম করা হয় ‘ঈগল কোম্পানী’ নামে। ট্রেইন্ডদের নিয়ে এ কোম্পানী গঠন করি বিশেষ করে আমার এলাকার যুবক ছেলেদের নিয়ে ওই কোম্পানী গঠন করি। ওই কোম্পানী নিয়ে আমি অক্টোবরে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। এ সময় আমার সাথে ওয়ারলেস, টাইম বোম, এলএমজি, মর্টার এবং অন্যান্য হাতিয়ার ছিলো। এরপর আমি ভিতরে এসে শৈলকুপা থানা, শ্রীপুর থানাসহ অনেক জায়গা ক্যাপচার করি। তারপরে শত্রুর গতিবিধি ওয়ারলেসের মাধ্যমে ব্যারাকপুরে প্রেরণ করি।
এ সময় মাগুরার উপর যে বোম্বিং করা হয়েছিল আমি আমার বাহিনী পাঠিয়ে তাদের প্রতিরোধ করি। তারপর শেষ পর্যায়ে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে মাগুরা থেকে আমাদের সংযোগ স্থাপন হয়। তারপর আমরা এক সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাই। এসময় তাদের ফরিদপুর যাওয়ার আগে মধুমতি নদীতে আমি প্রচুর নৌকা সরবরাহ করি। মধুমতির ওইপারে ব্রিজেন্ড তৈরি করি। মিত্রবাহিনীর অনেকগুলো ট্যাংক নিয়ে আমরা ওই পারে অবস্থান নেই। শত্রুর অবস্থানের বিষয়ে আমি মিত্রবাহিনীর গান পজিশনে খবর পাঠাই, এরপর মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি শত্রু বাহিনীর উপর কামান দাগে। এ সময় মিত্রবাহিনীর প্লেন দিয়েও শত্রু বাহিনীর উপর আক্রমণ চালানো হয়। এমনিভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে। ১৫ ই ডিসেম্বর আমি যখন ব্রিগেট কমান্ডার জগন্নাথের রুমে ছিলাম। তখন জানতে পারলাম পাকিস্থানি বাহিনী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করেছে।

Magura MP Pic

প্রশ্ন : আপনার সেক্টরের অধীনে কতজন সৈনিক ছিলো ?
উত্তর : আমার অধীনে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার সৈন্য ছিল। এগুলো রেগুলার ফোর্স। আরও অসংখ্য গণবাহিনীর সদস্য ছিল আমার সাথে।

প্রশ্ন : কোন প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা যুদ্ধ অবসম্ভাবী হয়ে উঠেছিলো বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : ১৯৪৭ সালে যখন কংগ্রেসের সঙ্গে কথাবার্তা হয়, তখন তাদের কথাবার্তায় মনে হলো তারা এখন যাই দিক ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর পুরো অস্তিত্ব নিয়ে নেবে। এইটা মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ বুঝতে পারলেন। তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, পাকিস্তান ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নাই। যা হোক তখন বিশেষ করে লন্ডন থেকে যখন তাদের প্রোপজাল এ্যাপরুভ হয়ে আসলো তখন মাউন বার্টন জিন্না সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আপনি কি চান ? তখন জিন্নাহ সাহেব বললেন পাকিস্তান। ওইটাই এ্যাকসেপ্ট হয়ে গেল। পাকিস্তান হলো। এ সময়ের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান ক্রিয়েশনের পিছনে বাঙ্গালিদেরই বেশি অবদান। আমাদের অনেক আশা ছিলো। এসময় মুসলিম লীগের কনভেনশন হয় ঢাকাতে স্যার সলিমুল্লাহর তত্ত্বাবধানে। উনি ওই সময় অনেক অর্থ খরচ করেছিলেন। শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক বিভিন্ন প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। বাঙালিদের অনেক আশা যে আমাদের অনেক উন্নতি হবে। কিন্ত দেশ স্বাধীনের পর দেখা গেলো যে, পশ্চিমারা লুন্ঠন, অর্থনৈতিকভাবে আমাদেরকে শোষণ করতে থাকলো। তারপরে ’৪৮ সালে যখনে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসলেন, উনি একবার রেসকোর্সে, আবার কার্জন হলে বললেন যে, ‘উর্দু এণ্ড অনলি উর্দু উইল বি দ্য এস্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’। এতে বাংলার ছাত্র-জনতা সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। তারা বললো, ‘আমরা মানি না, মানি না’। তারপরে ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতার উপর গুলি চালায়। বরকত, সালাম, রফিক অনেকে এই আন্দোলনে নিহত হন। তারপর ’৫৪ সালে যখন যুক্তফ্রন্টের ইলেকশন হলো, মুসলিম লীগ ধরাশায়ী হলো। যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুস সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলো। মে মাসে ১৫ তারিখ সম্ভবত একে ফজলুল হক শপথ নিলেন। পনের দিন পর তাকে সরিয়ে দিয়ে গভর্নর রুলস চালু করলো। ইস্কান্দার মির্জা সাহেব হলো ‘গভর্নর অব ইস্ট পাকিস্তান’। আবার নিষ্পেষণ চলতে থাকলো। তারপর ’৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব গণতান্ত্রিকভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন। উনি মাত্র ১৩ মাস প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারপরে গোলাম মোহাম্মাদ সাহেব ছিলেন গভর্নর জেনারেল। যা হোক. উনি অসুস্থ হয়ে যান। তখনে ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। তারপরে ’৫৯ ইলেকশন হওয়ার কথা ছিলো, ইস্কান্দার ভাবলো ইলেকশন হলে মনে হয় থাকতে পারবো না। তাই সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে ডেকে তার সহায়তায় ‘মার্শাল ল’ জারি করলো। ‘মার্শাল ল’ চালু করার পর কনস্টিটিউশন স্থগিত করলো। করার পরে আবার নিষ্পেষণ চলতে থাকলো। পাকিস্তানের কোন কনস্টিটিউশন ছাড়াই দেশ শাসন চালাতে থাকলো। ওই সময় মেম্বার চেয়ারম্যানের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হলো। আইয়ুব খান ‘দি কণ্ট্রোল ডেমোক্রাসি’ চালু করলো। তারপর আইউব খান এক সিগনেচারের বলে আবার একটা কনস্টিউিশন বানায়ে তা এপ্রুভ করলো। তারপরে আমাদের সোহরাওয়ার্দী সাহেব ইন্তেকাল করলেন। আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ ক্ষমতা নিল এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি তুললেন। অনেক আওয়ামী লীগের এমপি বেড়িয়ে গেলেন। যা হোক ৬ দফা ছিলো বাঙালিদের মুক্তি সনদ। এটাকে দাবানোর জন্য আইউব খান ৩৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। বঙ্গবন্ধু এক নম্বর আসামি ছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে মাশাল ল ট্রাইবুনাল চলে। সেখানে দুইজনকে গুলি করা হয়। গুলি করলে আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে যায়। পাকিস্তান সরকার সেই কেস উইথড্রো করতে বাধ্য হয়। রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। তারপর আইয়ুব খান চলে যায় ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রপতি হয়। যাহোক ’৭০ সালে ইলেকশন হলো। ইলেকশনে আওয়ামী লীগ পুরো পাকিস্তানে একক মেজরিটি পেল। তখনে জাতীয় সংসদ বসার কথা, কিন্তু সংসদ না ডেকে ইয়াহিয়া খান তার হায়েনাদের বাঙালিদের উপরে লেলিয়ে দেয়। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমি ওই সময় যশোর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করি। ওখান থেকে বেড়িয়ে আসি। বেড়িয়ে এসে ৮নং সাব-সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করি।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে আপনার স্মরণীয় একটি ঘটনা বলুন।
উত্তর : ’৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পন করলো, এটাই মুক্তিযুদ্ধে আমার স্মরণীয় দিন বা ঘটনা। আমরা ওই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। শেষ পর্যন্ত তারা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে সারেন্ডার করলো।

প্রশ্ন : একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
উত্তর : দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চাই, প্রশাসন চাই, দেশের উন্নতি চাই, দেশের জন্য আওয়ামী লীগ যে, রূপকল্প ২০২১ নিয়েছে আর ২০৪১। ২০২১ সালে দেশ যেন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। আর ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হয় এই প্রত্যাশা করি। আর যে সমস্ত মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলো দেশের অর্থে না হলে অন্য দেশের সহযোগিতা নিয়ে করতে হবে। তাহলেই দেশ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।

মুসাফির নজরুল : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মেজর জেনারেল (অবঃ) এটিএম আবদুল ওয়াহ্হাব এমপি: আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।