বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আজকের অবস্থানে আসার পেছনে যে কজন মানুষ বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন চিত্রনায়িকা ববিতা তাদের অন্যতম। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী এই অভিনেত্রীর সাথে কথা বলেছেন  মাগুরাবার্তা 24.কম এর উপদেষ্টা সম্পাদক ঢাকাস্থ ফটো সাংবাদিক শাহিনুর আহমেদ।

magurabarta24.com Bobita 1

নায়িকা ববিতার পুরো নাম ফরিদা আক্তার পপি। প্রথম যেদিন গুলশানে তার বাসায় গেলাম সেদিনই মুগ্ধ হলাম। একটি সুন্দর ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বাংলার কিংবদন্তী এ নায়িকা। মুগ্ধ হলাম তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দেখে। মুগ্ধ হলাম মানুষকে ভালবাসার এক অসাধারণ গুণ দেখে। দুরু দুুরু বুকে কাছে গিয়ে তাকে বললাম আপা আমি আপনার ভক্ত।  আপনার ছবি তুলবো। সে সময়ই তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। প্রথমেই নিজ হাতে আপ্যায়ন করলেন। পরিচয়  ‍পর্বে আমার বাড়ি মাগুরায় জেনে তিনি জানালেন তার বাড়ি আমাদের বৃহত্তর জেলা যশোরের সার্কিট হাউজ রোডে।

একজন আধুনিক মানুষের পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি ববিতা। এই বয়সেও তিনি আকর্ষণীয়া স্মার্ট। পোষাক পরিচ্ছদে এখনো অনেক রুচিশীল। তিনি জানালেন- অধিকাংশ সময়ই নিজের ড্রেসের ডিজাইন তিনি নিজেই  করে থাকেন। এমনকি তার সঙ্গে যেসব নায়ক অভিনয় করতেন। তার ড্রেসের সাথে ডিজাইনের মিল রেখে সেই ধরণের ডিজাইনের কাপড় তৈরী করে নিয়ে গিয়ে সেটের সবাইকে চমকে দিতেন। এ কারণেই নায়িকা থাকা কালিন সেটের সবার খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। ছোট বড় সবাইকে ভালবাসা অসামান্য গুণের কারণে এখনো সবাই তাকে সমান ভালবাসেন।

ববিতার বাসায় ঢুকতেই একটি পরিপাটি অবয়বের চেহারা স্পষ্ট চোখে পড়ে। ঘরে ঢুকতেই পোষা ময়নার সুরেলা সম্বোধন সবাইকে চমকে দেয়। সারা বাড়িতে জানা অজানা নানা রং এর ফুলের গাছ, নানা ধরণের সবজি গাছ আর অর্কিডের সমন্বয়ে চারদিকেই রুচির ছোঁয়া।

৬২বছর বয়সেও প্রচুর পড়াশোনা করেন এই মিষ্টি নায়িকা। যেখানেই যান একটি কলম ও নোটবুক সাথেই থাকে। যে কোন অজানা তথ্য জানলেই তা টুকে নেন নিজ নোটবুকে। এ কারণেই কথায় কথায় তিনি তথ্য উপাত্ত দিয়ে মানুষকে চমকে দিতে পারেন।

প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবাল এর সম্পর্কে তিনি বলেন- তার সাথে জুটি হিসেবে আমরা খুবই জনপ্রিয় ছিলাম। তাঁর অকালে চলে যাওয়া আজও আমাকে কাঁদায়। আর নায়ক রাজ রাজ্জাককে তো তিনি রীতিমত আইডল মনে করেন। তিনি বলেন- নায়ক রাজ রাজ্জাকের কন্যার ভূমিকায় অভিনয় করেছি। আবার তার সাথে নায়িকা হিসেবে জুটি বেধেও সফল হয়েছি।

magurabarta24.com Bobita 3

৭০ ও ৮০র দশকের অনবদ্য এ নায়িকা অস্কারজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পরিচালক সত্যজিত রায়ের অশনি সংকেত ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রশংসা পান।  ববিতা ২৫০ টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তিনি পরপর তিন বছর একটানা জাতয়ি চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

তিনি ১৯৫৩ সালে বাগেরহাট জেলায় জন্ম নেন। তাঁর বাবা নিজামুদ্দীন আতাউব একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন এবং মাতা বি. জে. আরা ছিলেন একজন চিকিৎসক। বাবার চাকরি সূত্রে তারা তখন বাগেরহাটে থাকতেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি যশোরে। শৈশব এবং কৈশোরের প্রথমার্ধ কেটেছে যশোর শহরের সার্কিট হাউজের সামনে রাবেয়া মঞ্জিলে। তিন বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়বোন সুচন্দা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, বড়ভাই শহীদুল ইসলাম ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, মেজভাই ইকবাল ইসলাম বৈমানিক, ছোটবোন চম্পা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী এবং ছোটভাই ফেরদৌস ইসলাম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা।  এছাড়াও অভিনেতা ওমর তাঁর ভাগ্নে এবং অভিনেত্রী মৌসুমী তাঁর ভাগ্নে বউ (ওমর সানীর স্ত্রী) এবং অভিনেতা রিয়াজ তাঁর চাচাত ভাই। চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান তার ভগ্নিপতি। ববিতার একমাত্র ছেলে অনীক কানাডায় পড়াশোনা করেন।

তার চলচ্চিত্র কর্মজীবনে আসার পেছনে বড়বোন সুচন্দার অনুপ্রেরনায় রয়েছে। বড়বোন সুচন্দা অভিনীত জহির রায়হানের সংসার চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে ববিতার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে। এই চলচ্চিত্রে তিনি রাজ্জাকসুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রাথমিক নাম ছিলো “সুবর্ণা”। তিনি কলম নামের একটি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছিলেন সে সময়। জহির রায়হানের জ্বলতে সুরুজ কি নিচে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়েই তাঁর নাম “ববিতা” হয়ে যায়। ১৯৬৯ সালে শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন প্রথম নায়িকা চরিত্রে। ১৯৬৯ সালের ১৪ই আগস্টে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় এবং ঐদিন তাঁর মা মারা যান। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে ভগ্নিপতি জহির রায়হানের পথ প্রদর্শনে চললেও পরে তিনি একাই পথ চলেছেন। ৭০’-এর দশকে শুধুমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি গোটা দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।

magurabarta24.com Bobita 4

ববিতা অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের তালিকা

ববিতার প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারঃ

বছর চলচ্চিত্র পুরস্কার বিভাগ ফলাফল
১৯৭২ জহির রায়হান পদক বিজয়ী
১৯৭৩ অশনি সংকেত বেঙ্গল ফ্লিম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিজয়ী
১৯৭৪ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি বিজয়ী
১৯৭৫ বাদী থেকে বেগম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিজয়ী
১৯৭৬ নয়নমনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিজয়ী
১৯৭৭ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি বিজয়ী
বসুন্ধারা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিজয়ী
১৯৮০ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি বিজয়ী
১৯৮৫ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি বিজয়ী
রামের সুমতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিজয়ী
১৯৮৯ এরশাদ পদক বিজয়ী
১৯৯৩ অশনি সংকেত বাংলা চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি বিজয়ী
১৯৯৬ পোকামাকড়ের ঘর বসতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিজয়ী
অশনি সংকেত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি বিশেষ পুরষ্কার বিজয়ী

ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া ববিতার স্বাক্ষাতকার:

 

 

https://www.youtube.com/watch?v=owPpLE2cbdQ

তথ্য সূত্র : স্বাক্ষাতকার ও ইন্টারনেট