মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
দশ/বারো বছরের শিশু শ্রমিক দিপুল মোল্যা। মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে। মা, অসুস্থ বাবা  আর এক বোন নিয়ে তার সংসার। বড় তিন ভাই অন্যত্র সংসার পেতেছে। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। দিন শেষে হাতে আসে ২০০ টাকা। এই টাকায় চলে সংসার।
আরেক শিশু রিয়াজ শেখ (১২)। এই বয়সে তার হাতে ভ্যানের হাঁতল। কাঁধে সংসারের বোঝা। মহম্মদপুর সদরে সারা দিন ভ্যান চালিয়ে পায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এই টাকায় চলে বাবা, মা ও দুই ভাইয়ের সংসার।
যে বয়সে বন্ধুদের সাথে হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে সংসারের আয় উপার্জনের জন্য সারা দিন ইট টানতে ও  ভ্যান চালাতে হয় এই দুই শিশুর।
শুধু রিয়াজ ও দিপুল নয়। মাগুরায় এরকম কয়েক হাজার শিশুর নরম কাঁধে সংসারের কঠিন বোঝা। পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় চোখে মুখে মায়া জড়ানো এসব শিশুর  কঠিন শ্রমের কাজ করতে হচ্ছে।
মাথার উপর গনগনে সূর্য। ফর্সা কচি মুখ বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। দিপুলের মাথায় সাতটি ইট। একবারে সে সাতটি ইট টানতে পারে।  এর মধ্যেই ডাক পড়ল তাড়াতাড়ি আয়। রাজ মিস্ত্রীর ডাক। কথা বলার ফুসরত নাই। রাজ মিস্ত্রী ইউনুস আলীর কাছে সাংবাদিক পরিচয়ে কথা হলো দিপুলের সাথে।
দিপুলের বাড়ি মহম্মদপুর উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে দীঘা ইউনিয়নের আউনাড়া গ্রামে। বাবা রুহুল মোল্যা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। মা সাহেরা বেগম অন্যের বাড়িতে মৌসুমি শস্য মাড়াইয়ের কাজ করেন। চার ভাই দুই বোন তাদের। বড় তিন ভাই  বিয়ে করে অন্যত্র সংসার পেতেছেন। তারা খোঁজ নেয় না। সংসারের টানাটানি আর পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে সে আজ ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমিকের কাজে নেমেছে। ৪ থেকে ৫ বছর পর কাজ শিখলে মিস্ত্রী হতে পারবে দিপুল।  তখন তার আয় বাড়বে, সংসারে সুখ আসবে, সেই আশায় সারাদিন পরিশ্রম করছে  সে।
বাড়ির পাশে আউনাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়া লেখা করে আর পড়া হয়নি তার।
রাজ মিস্ত্রী ইউনুস আলী বলেন,‘ দিপুল তার সাথে একমাস ধরে কাজ করছে। ছোট মানুষ বুঝি তারপরও (দিপুল) টাকার দরকার। কাজে না নিলে ওর পরিবার না খেয়ে থাকবে।
তিনি আরও জানান,‘শিশু শ্রমিকেরা কথা শোনে। ভালো কাজ করে। বেতনও বড়দের চেয়ে কম।’
দিপুল জানায়, ‘তার লেখা পড়ার ইচ্ছা ছিল। স্কুলের ফাঁকে কাজ করত। কিন্তু বাবা অসুস্থ্য হওয়ায় তা আর হলো না।’ তার প্রশ্ন, ‘আমি পড়ালেখা করলে বাবা-মাকে খাওয়াবে কে ?’
আরেক শিশু ভ্যান চালক রিয়াজ শেখ (১২)। তার গল্পটা একটু ভিন্ন। তার বাড়ি মহম্মদপুর উপজেলার সদরের ধোয়াইল গ্রামের মধ্যে পাড়ায়।  বাবা মঞ্জুর শেখ পেশায় ভ্যান চালক। মা সুফিয়া বেগম গৃহিনী। তিন ভাইয়ের মধ্যে রিয়াজ বড়। রিয়াজ ধোয়াইল আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। স্কুল বন্ধের সময় ও  ছুটির পর বিকেলে ভ্যান নিয়ে বের হয়। ১৫০ -২০০ টাকা আয় করে।  ছুটির সময় পুরো দিন ভ্যান চালায়। বাবা এসময় কৃষি জমিতে শ্রমিকের কাজ করেন।
ভ্যান চালানোর আয়  আর উপবৃত্তির টাকা দিয়ে রিয়াজ লেখাপড়া  চালিয়ে যেতে চায়। একটা চাকরি করে বাড়িতে ভালো ঘর তোলার ইচ্ছা- জানায় রিয়াজ।
রিয়াজের বাবা মঞ্জুর শেখ জানান, ‘সংসারে  বাড়তি আয়ের জন্য ছেলেকে ভ্যান চালাতে পাঠান। এই বয়সে ব্যস্ত সড়কে ভ্যান চালায়। সবসময় চিন্তায় থাকি কখন কী হয় । সামনে তার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। গ্রীষ্মের বন্ধে কিন্তু পড়ালেখা বাদ দিয়ে প্রতিদিন নয় ঘণ্টা ভ্যানে যাত্রী টেনে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পায়। রিয়াজের মতো অনেক শিশুই এ রকম শ্রমে যুক্ত হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন রাস্তায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখা মেলে অনেক শিশু ভ্যানে যাত্রী টানছে।  পরিবার চালানোর দায়িত্ব কাঁধে ওঠায় তারা লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। অনেককে স্কুলের পোশাকেই ভ্যান চালাতে দেখা গেছে।
মহম্মদপুর সদরের প্রবীন সংবাদকর্মী আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘অভাব, দারিদ্র্য, অসচেতনতার কারণে জেলায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, শ্রম আইন, ২০০৬ অনুসারে, কাজে যোগদানের নূন্যতম বয়স হচ্ছে ১৪ বছর আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে তা ১৮ বছর।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলা সদর, শ্রীপুর, মহম্মদপুর ও শালিখা  উপজেলার মোট ৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলতি ২০১৭ সালে ভর্তি হয়েছিল এক লাখ ৫ হাজার ১১৯ জন শিশু। এর মধ্যে ঝরে পড়েছে ৮ দশমিক ০৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৬ হাজার ৯৬ শিশু।
মাগুরা  জেলা সহকারি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কুমারেশ চন্দ্র গাছী বলেন, দারিদ্র্য, ও লোকজনের অসচেতনতা, বাল্যবিবাহসহ নানা কারণে শিশুরা ঝরে পড়ছে।
এই শিশুরা অল্প বয়সে শ্রমে নিযুক্ত হওয়ায় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত  হয়। আবার এর কারণে তাদের শিক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগও সীমিত হয়। তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেতেই থাকে। তাই শিশু অধিকার নিশ্চিত ও শিশুশ্রম বন্ধ করতে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।’
০২ মে ২০১৭/ মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন/ রূপক/মাগুরা