বিশেষ প্রতিনিধি, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
মাগুরা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে  আঠারখাদা গ্রামে নবগঙ্গা নদীর তীরে সিদ্ধেশ্বরী মঠ অবস্থিত।  সু-প্রাচীন কালের এই মঠটি কালিকাতলা শ্মশান নামেও পরিচিত। অতি প্রাচীন কাল হতে এই শ্মশানে একটি মঠ এবং সিদ্ধেশরী মাতার মন্ত্রে-মন্ত্রাঙ্কিত শিলাখন্ড ও কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল।
গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ এই স্থানটি ছিলো সন্যাসীদের তপস্যা স্থল। সপ্তদশ শতকে এবং তার আগেও এখান থেকে নবগঙ্গা ধরে পূর্ন্যাত্না ব্যক্তিরা তীর্থে কামাক্ষ্যা যেতেন। সে কারনে ঐ সময় স্থানটিতে বহু সাধুজনদের সমাগম ঘটতো। এক সময়ে রঙ্গমাচার্য নামে বর্তমান  চট্রগ্রাম অঞ্চলের এক সন্যাসী সিদ্ধেশ্বরী মঠের মঠ-স্বামী ছিলেন। বহুকাল পরে যখন ব্রহ্মান্ডগিরি বা ব্রহ্মানন্দগিরি নলডাঙ্গার অধিশ্বর শ্রীমন্ত রায় বা রনবীর খাঁকে দীক্ষিত করেন, সেই সময় থেকে তিনি এই কালিকাপুর সিদ্ধেশরী মঠে এসে বসবাস  শুরু করেন। তখন মঠে সন্যাসীদের বাসপযোগী তেমন কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। তখন নলডাঙ্গার অধিশ্বর শ্রীমন্ত রায় দীক্ষা গুরু ব্রহ্মান্ডগিরির আদেশে  পূর্ববর্তী মঠে সাধুগণের বাসউপযোগী আশ্রম নির্মাণ করে দেন এবং ২৫০ বিঘা জমি নিষ্কর ভূ-সম্পত্তি দেবোত্তর সরুপ দান করেন।

3
মাটির নিচ থেকে উঠে আসা প্রাচীন কারুকার্যময় ইট। – ছবি: মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

ব্রহ্মান্ডগিরি বহুকাল জীবিত ছিলেন। রাজা চন্ডীচরণ, ইন্দ্রনারায়ণ ও সুরনারায়ণ সবাই তার শিষ্য। ব্রহ্মান্ডগিরি অর্ন্তধ্যানের পর মাগুরা কালিকাপুর সিদ্ধেশ্বরী মঠের দিকে পরবর্তী রাজাদের সু-দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি। মঠস্বামীদের নিযুক্ত গোমস্থাদের অযত্ন ও স্বার্থপরতার জন্য ক্রমেই উহার পূজাদির অব্যবস্থা এবং মঠের দুরাবস্থা হতে থাকে। শিলাখন্ড খানি অপহৃত হয় এবং মন্দিরাদি ভগ্ন ও ভুমিসাৎ হয়। পুজার ঘটটি পর্যন্ত স্থানান্তরিত হয়ে কোন প্রকারে রীতি রক্ষা হতে থাকে। এমনকি কয়েকজনে মঠের স্থানটি পর্যন্ত নিজের সম্পত্তিভুক্ত করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু দৈব প্রতিবন্ধকাতায় উহারা সফল হয়নি। সকলেই কালগ্রস্থ বা নিঃবংশ হয়েছেন। এই জন্য স্থানটি ভীষন  জঙ্গালাকীর্ণ হয়ে পড়ে। মায়ের কৃপা কটাক্ষ পাতে প্রায় দুইশত বছর পর অমলানন্দ নামক একজন ব্রাহ্মন সাধু সন্যাসি স্বপ্নাদেশ অনুসারে উক্ত স্থানে এসে পুনরায় মঠ প্রতিষ্ঠা করেন।  আবার কালিকাপুর কে জাগিয়ে অমলানন্দ সন্যাসি কালিকাপুর মঠের প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নস্তুপের উপর নতুন পাকা মন্দির নির্মাণ করেন এবং তার মধ্যে এক অপুর্ব মৃন্ময়ী কালিকা প্রতিমা স্থাপন করেছিলেন। দুটি শব’ শিশু কাঁধে করে নীল বরনী শ্যামা শিব বক্ষে নৃত্য করেছেন। তার ভীষণামুর্তির অন্তরাল হতে দিব্য কিরণ দৃষ্টি বিচ্যুতি হয়ে পড়েছে। 2
বর্তমানকালে এই ধরনের মূর্তি আর কোথাও দেখা যায়না ।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পরবর্তীতে  নলডাংগা রাজাদের ইচ্ছানুযায়ী ব্রহ্মান্ডগিরি মাগুরা কালিকাপুর সিদ্ধেশরী মঠের অনুকরনে নলডাংগাতে সিদ্ধেশরী দেবীর মন্দির নির্মাণ করে দেন।

যাহোক ইং-১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পাক-দোসর কর্তৃক মন্দিরের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। শুধুমাত্র মন্দিরের সামনের তিনটি পিলার সহ মন্দিরের পাকা ভিটা ছিল। পরবর্তীতে কোন একদিন কালীমাতার সাধক কুন্ডেশ্বরী ঔষুধালয়ের কবিরাজ শ্রী দুলাল অধীকারি সপ্নাদ্রষ্ট হয়ে এ্যাডঃ দীপক রায় চৌধুরী, স্বর্ণ ব্যাবসায়ি নারায়ণ চন্দ্র দাস, হস্তরেখাবিদ শ্যামাপ্রসাদ ভট্ট্যাচার্য্য প্রমূখ ব্যক্তিগণকে জানান এবং উক্ত ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় পুনরায় মন্দির সংস্কার করে এবং মায়ের মূর্তি তৈরী করে নিয়মিতভাবে পুজার ব্যবস্থা শুরু করা হয়। অবশ্য উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও নিম্নে বর্ণিত ব্যক্তিবর্গগণের অবদান অবিস্মরণীয়। ব্যবসায়ী মন্টু সিকদার, সাংবাদিক অধ্যাপক মিহির লাল কুরী, ব্যবসায়ী বিকাশ ভট্টাচার্য্য, শিক্ষক মিলন ভট্টাচার্য, অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক কালিদাস ভট্টাচার্য্য, শিক্ষক শান্তিপদ সিকদার প্রমুখ।

অনেকেই নলডাংগা সিদ্ধেশরী মন্দির স্থাপত্যের ইতিহাসের সাথে মাগুরার সিদ্ধেশরী মন্দিরের ইতিহাসকে এক করে ফেলেন, আসলে দুইটির ইতিহাস ভিন্ন, কিন্তু একথা ঠিক যে মাগুরা সিদ্ধেশরী মন্দিরের পশ্চাতে নলডাঙ্গার রাজাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মাগুরা সিদ্ধেশরী মন্দির অতি প্রাচীনকালে স্থাপিত হয়েছে যার সঠিক স্থাপত্য সন জানা যায় না। কে বা কারা এই মন্দির নির্মাণ করেন তাও  জানা যায় না। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নলডাঙ্গার কালিকাপুর এবং মাগুরা কালিকাপুর ভিন্ন স্থান মাগুরা কালিকাপুর  সিদ্বেশ্বরী মন্দির অতি প্রাচীণকালে স্থাপিত, আর নলডাঙ্গা কালিকাপুর সিদ্ধেশরী  মন্দির মোগল আমলে স্থাপিত।

সম্প্রতি মন্দিরটি নতুন করে তৈরী করা হয়েছে। বর্তমানে  এখানে প্রতি পূণ্য তিথিতে এখানে জাঁকজমপূর্ণভাবে পূজা অর্চনা হয়।

নতুন এ মন্দিরটি নির্মানের উদ্দেশ্যে খনন করে প্রায় ১০ ফিট মাটির নিচে পাওয়া গেছে প্রায় হাজার বছর আগের একটি মন্দিরের ধ্বংশাবশেষের কিছু নিদর্শন।

সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে কারুকার্যময় নকশা করা বিভিন্ন আকারের ইট। আরো পাওয়া গেছে একটি পুরাতন প্রচীর। হাজার বছর আগের এ নিদর্শন দেখতে সিদ্ধেশ্বরী মঠপ্রাঙ্গণে প্রতি দিন ভিড় করছেন শত শত নারী পুরুষ।

এখানে যেটুকু অংশ খনন করা হয়েছে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কারুকার্যময় নানা রকমের ইট। মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন হয়তোবা সেখানে প্রায় এক হাজার বছর আগে একটি মন্দির ছিল। যেটি কালের বিবর্তনে মাটির নিচে চাপা পাড়ে গিয়েছিল।

সরেজমিনে মঠে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে শত শত ছোট ছোট কারুকার্যময় নানা আকৃতির ইট। সেই সাথে দেখা গেছে একটি কারুকার্যময় নকশা করা প্রাচির। এ ইট গুলি মন্দিরের ঘরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

খনন কাজে অংশগ্রহণকারী জগদিশ চন্দ্র জানান, এ ইট গুলি প্রায় হাজার বছর আগেকার হবে। তবে প্রত্নতত্ম অধিদপ্তর বলতে পারবে এটি আসালে কত বছর আগেকার ইট ও প্রাচীর। তবে তাদের ধারনা এটি ৮০০ থেকে ১ হাজার বছর আগের হতে পারে।

সিদ্ধেশ্বরী মঠের পুরোহিত সুশান্ত ব্যানাজী জানান, আমরা ইটগুলি সংরক্ষণ করে রেখেছি। এই ইটগুলির নকশা অনুকরন করে সুন্দর কটি মন্দির নির্মান করা হবে এখানে। মাটির তলের এ মন্দির সম্পর্কে আমাদের কোন তথ্য জানা নেই। তবে তথ্য জানার চেষ্টা করছি এগুলি কত বছর আগেকার আর কে বা নির্মান করেছিলেন এই মন্দিরটি।

সিদ্ধেম্বরী মঠের কর্মকর্তা অধ্যাপক মিহির লাল কুরি জানান, সিদ্ধেশ্বরী মঠে খনন করে যে ইট গুলি পাওয়া গেছে তা বহু প্রাচীন। এ গুলি আমারা সংরক্ষণ করে রাখার চেষ্টা করছি। এখানে ১০ ফুট গভীর খনন কাজ করা হয়েছে। যেটুকু খনন করা হয়েছে সেখান থেকে এই পুরাকৃত্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। আরো খনন করলে এ ধরনের অনেক ইট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিটি ইটই টেরাকুটা পুরামাটির নানা কারুকার্জময় নকশায় তৈরি।

রূপক/জয়ন্ত/১৫ডিসেম্বর১৬