স্মৃতি চারণ 
আলহাজ্ব মোঃ মুনসুর আলী মাগুরার একজন সৎ, মৃদুভাষী, সর্বদা প্রফুল্ল নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবী ছিলেন । ২০২১ সালের ০৫ জানুয়ারি অসংখ্য গুনগ্রাহী ও আত্মীয় স্বজনদের ছেড়ে প্রায় ৯০ বছরের দীর্ঘ জীবনের পর চিরকালের জন্যে এই জগৎ ছেড়ে বিদায় নিলেন।

মুনসুর আলীর জন্ম মাগুরা সদরের পাথরা নামক গ্রামে। গ্রামটি মাগুরা থেকে মাইল তিনেক দক্ষিণে ছোট্ট একটি নদী ফটকির ফুটফুটে জনস্রোতের পাড়ে আম-কাঠাল আর বাঁশঝাড়ে ঘেরা স্বপ্নিল এক পল্লী। তখনকার একমাত্র প্রাইমারি বিদ্যালয়টি ছিলো গ্রামের নদীটির ওপারে বড়কড়ই গ্রামে। পরবর্তীতে হাইস্কুলে যেতে হতো কাদাপানি পেরিয়ে মাইল তিনেক দূরে মাগুরা শহরে। তাঁর কলেজ জীবনও কাটে মাগুরায়। প্রবেশিকা পরীক্ষার পর পরিবার আর তাঁকে পড়াতে পারেনি। স্বল্প বেতনে চাকরি শুরু করেন মাগুরার রেভেন্যু আফিসে। সে সময়েই তিনি বিবাহ করেন উত্তর মাঝাইল গ্রামের মালেক পন্ডিতের মেয়ে আয়েশা খাতুন ঝর্নাকে। মালেক পন্ডিত এই বিয়ের বৎসর তিনেক পূর্বে ইন্তেকাল করেছিলেন। মরহুমের সংসারের নাবালক তিন পুত্রের দেখাশোনার ভার পড়লো তাঁর উপর । তবে তাঁর বুদ্ধিমত্তায় শ্বাশুড়ি উম্মিয়া খাতুন এই নতুন দম্পতিকে সার্থক সংসার গড়তে সকল প্রকার সহায়তা করেছিলেন।

এরপর মুনসুর আলী বদলি হলেন ছোট্ট শহর শৈলকুপায়। সেখানকার মানুষগুলো ছিলো উদার আর সাংস্কৃতিমনা। সহসাই তিনি নানা সাংস্কৃতিক এবং সমাজকল্যানমূলক কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি মাগুরায় বদলি হয়ে আসেন । তাঁর সততা, কর্মদক্ষতা ও একাগ্রচিত্ততার জন্যে সহসাই তাঁকে করা হয়েছিল মাগুরার ডিসি অফিসের নাজির। এই কর্মে তিনি প্রায় একটানা বারো বছর নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর কর্মক্ষমতা আর সততা ছিলো শিক্ষণীয়। এ সময়ে মাগুরায় অনেক সরকারী দোকান ও জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। সেগুলো তাঁর পর্যায়ে পদ্ধতিকরণ করে বরাদ্দ করতে তিনি সহায়তা করেছিলেন। এসবের দিকে তাঁর কোনো লোভ বা আকর্ষণ ছিলনা। শহরতলিতে বানিয়েছিলেন ছোট্ট একটি টিনের বাড়ি। সেখানেই তাঁর মেয়ে আর দুই ছেলে বড়ো হয়েছিল। ছেলে-মেয়েরা আজ সকলেই দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। শ্বশুর বাড়ীর তিন শ্যালকও তাঁর স্নেহছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

সারা জীবন তিনি সমাজ সেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সুখে দুঃখে গ্রামের মানুষের পাশে সহসাই হাজির হ’তেন। তাঁর গ্রামের ও তাঁর শ্বশুর বাড়ীর এলাকার অনেকেই তাঁর হাত ধরে সরকারি বেসরকারি চাকুরী পেয়েছেন। কখনোই কারো উপর তিনি বিরক্ত হতেন না। গ্রামের মানুষ বাড়িতে এলে তাঁর শুভ্র মুখমন্ডলটি খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। এমন কোন মানুষ ছিলেন না যিনি তার বাড়িতে এসে সহধর্মিনী ঝর্নার তৈরি চা-নাস্তা বা সময় উপযোগী আহার গ্রহন করেননি। তাঁর মনটি ছিল গ্রামের ফটকি নদীর বিস্তর জলাশয়টির মতো উদার আর প্রশান্ত। কোন টাকা পয়সা ছাড়াই গ্রামের লোক ডাক্তারী প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ কিনতে হাজির হতেন তাঁর কাছে। নিজের টাকায় বা ধার-কর্জ করে তিনি তাঁদের ওষুধ কিনে দিতেন। নিজ এলাকা ও স্ত্রীর গ্রাম অঞ্চলের জন্য তিনি ছিলেন একজন বটবৃক্ষ। সময়ে অসময়ে মানুষ তাঁর সাহায্য-সহানুভূতির জন্য তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হতেন।

অবসর জীবনে তিনি মাগুরা হাজী সাহেব হুজুরের মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমদের খেদমতে সারাক্ষণ কাজ করে গেছেন। শেষ বয়সেও সামাজিক অবক্ষয় দেখে তিনি বড়ই দুঃখ পেতেন । তাছাড়া প্রায়ই আফসোস করতেন যে বড় শহরে জন্ম হওয়া নতুন প্রজন্ম সমাজ ও নিজের গ্রামীণ শিকড় ও সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য বোধ সচরাচর দূর্বল। মুনসুর আলী তাঁর জীবদ্দশায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে মানুষকে সেবা করতে প্রচুর অর্থ, প্রতিপত্তি বা প্রভাবের প্রয়োজন নেই । ত্যাগ, দৃঢ় ইচ্ছা আর দরদী মনোভাব দিয়েই এটা সম্ভব। এই সাদাসিধে ধার্মিক মানুষটি ইহকাল ছেড়ে চলে গেলেও রেখে গিয়েছেন মাগুরার হাজারো মানুষের অকৃত্তিম ভালোবাসা আর প্রাণভরা শ্রদ্ধা।

 

লেখকঃ স্নেহসিক্ত ডঃ কালাম শাহেদ,কানাডায় অবস্থানরত গবেষক ও লেখক