মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
ফররুখ আহমেদ তার বিখ্যাত কবিতা ডাহুকে বলেছেন- গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল/ হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম। নিভে যায় কামনা-চেরাগ/ অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক। কোন ডুবুরির/ অশরীরী যেন কোন প্রছন্ন পাখির সামুগ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে।

শুধু তিনি নন বিদ্যাপতি, জীবনানন্দ, চন্ডী দাস ও আল মাহামুদসহ অনেক কবির কাব্যের অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পাখি ডাহুক। ডাহুক-ডাহুকীর ডাকে মনের নানা অভিব্যক্তি ভেসে উঠেছে নানা কবিতায় ।

ডাহুক নিয়ে আলা মাহমুদ শেষবারের মতো খুঁজে ফিরেছেন তার স্মৃতি:
‘স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক/ অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায় ? ’
কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘মালঞ্চে পুষ্পিতা লতা অবনতমুখী,- নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী/বিজন-তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে/ বনচ্ছায়া-অন্তরালে তরল তিমিরে।’

চন্ডীদাস তার কবিতায় বলছেন,‘ভাদর মাঁসে অহোনিশি আন্ধকারে/ শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।/ তাত না দেখিবোঁ যবেঁ কাহ্নাঞিঁর মুখ/ চিনি-তে মোর ফুট জায়িবে বুক।’

মাগুরায় প্রকৃতির অনাবিল সুন্দর এই পাখি এখন আর আগের মতো দেখা যায় না। ডাহুক জলের পাখি। খুব ভীরু। জলাভূমির আশেপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা এই পাখিটি মাঝারি আকৃতির। লেজ ছোট। পা লম্বা। পায়ের আঙুলও বেশ লম্বা।

পিঠের রঙ ধূসর থেকে খয়েরী-কালো, মাথা ও বুক সাদা। লেজের নীচের অংশে লালচে আভা। ঠোট হলুদ রঙের, ঠোটের উপরে লাল রঙের একটি ছোট্ট দাগ আছে। তবে মজার ব্যাপার হলো বাচ্চাদের রং হয় সবসময় কালো। উদ্ভিদের ডগা এদের প্রিয় খাবার, এছাড়া জলজ পোকা-মাকড়, শ্যাওলা।
ডাহুক বাসা তৈরি করে মাটিতে,ঝোপের তলায়। পানি এদের প্রধান আশ্রয়। পুকুর, খাল, জলাভূমি, বিল, নদীর গোপন লুকানো জায়গা এদের খুব প্রিয়। পায়ের নখগুলো লম্বা লম্বা, ফলে পদ্ম ও শাপলা পাতায় দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এবং কচুরিপানার ওপর ছোটাছুটি করতে পারে। বাসা তৈরি করে মাটিতে, ঝোঁপের তলায়। জলজ উদ্ভিদের বীজ, কচুরিপানা ও কলমি ঝোপে পানির ওপর এরা খড়কুটো এবং শুকনো শ্যাওলা ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে গোলাকার পরিপাটি বাসা বানায়। ইংরেজি নাম :  White-breasted Waterhen বৈজ্ঞানিক নাম : Amaurornis phoenicurus ।

প্রজননকাল (জুন-সেপ্টেম্বর) আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। এই সময় তাদের মৃত্যুর হারও বেশি। ডিম পাড়ে ৬-৭টি। ডিমের রং ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। ডিমে তা দেয় স্ত্রী-পুরুষ উভয় মিলে।
বনে-বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ডাহুক-ডাহুকীর স্বার্থহীন ভালোবাসার গল্প প্রচলিত আছে।শুনলে অবাক হতে হয়। যখন সঙ্গীর খোঁজ না পায়, দিনরাত ডাকতে ডাকতে গলা চিরে রক্ত উঠে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মৃত্যুর কোলে। সত্যি কি মর্মান্তিক!

রাতে ডাহুকের ‘কোয়াক’ ‘কোয়াক’ ডাক শুনে সহজেই একে চেনা যায়। এই ডাক পুরুষ পাখির, যা বর্ষাকালে বেশি শোনা যায়। একটানা অনেকক্ষণ ডেকে এরা শ্বাস নেয়। কিন্তু মায়াবী এই পাখিটি চোরা শিকারি আর বাসস্থানের অভাবে দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জলাভুমির অতিচেনা নীল ডাহুক পাখিটিও হারিয়ে যাচ্ছে।

magura-dahuk-pic-01

আগে জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের ঝোপঝাড়, জলাশয় এবং কচুরিপানা সমৃদ্ধ পুকুরেও এদের দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বড় বড় বিল হাওর ছাড়া এদের দেখতে পাওয়া যায় না। ডাহুক একটি বিপন্ন পাখি।

মাগুরার বিশিষ্ট সাংবাদিক শামীম খান জানান,‘দশ বছর আগেও গ্রামে-গঞ্জে প্রচুর ডাহুক পাখির ডাক শোনা যেত। ডাহুকের ডাক সর্বশেষ কবে শুনেছি মনে পড়ে না। ঝোপ-জঙ্গল ও জলাভূমি কমে যাওয়ায় দিনদিন বিপন্ন হচ্ছে ডাহুকসহ পাখির আবাসভূমি। এছাড়া পোষা ডাহুক দিয়ে ফাঁদ পেতে এক শ্রেণির শিকারি ডাহুক ধরায় সুন্দর এই পাখিটি এখন আর দেখা যায়না বললেই চলে।

 

সম্পাদনা : রূপক আইচ/ ২২ অক্টোবর ১৬