বিশেষ প্রতিনিধি, মাগুরাবার্তা
মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার ঘুল্লিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র চাষি মোঃ কালাম শেখ। গত বছরও বর্ষা মৌসুমে এক বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করেছিলেন তিনি। আশা ছিল, ধান ঘরে তুলে ঋনের টাকা শোধ করবেন। কিন্তু তাঁর সেই আশায় বাদ সাধে অতিবৃষ্টি ও মধুমতি নদীর খাল দিয়ে ধেয়ে আসা পানি। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ধানক্ষেত তলিয়ে কয়েক দিনেই পচন ধরে ধানের চারায়। পুরো ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হন। গত বছরের চার দফা বন্যা ও জলাবদ্ধতায় এ এলাকার অনেক চাষির স্বপ্নই ধুলিস্যাত হয়ে গেছে একইভাবে। এ ধরনের ফসল হানি তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে উঠে। এমন প্রেক্ষাপটে আমনের ফলন কম হওয়ার সুযোগ নেন সুবিধাভোগী চাল ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন কালাম শেখ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন বাংলাদেশ পরমানু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট মাগুরা উপকেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত বিনাধান-১১’র খবর। এ বছর কৃষি বিভাগের সহায়তায় এ ধান চাষ করে তিনি জলাবদ্ধ জায়গায় ভাল ধান উৎপাদন করেছেন।
কালাম শেখ জানান- প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে তাদের গ্রামের মাঠে বিস্তির্ণ অঞ্চলে ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফলে ওই মৌসুমে জমিগুলি পতিতই পড়ে থাকে। এ বছর বিনা মাগুরা উপকেন্দ্রের সহায়তায় বেশ কিছু জমিতে বিনাধান -১১ এর চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন তিনি ও তার সহযোগি কৃষকরা। এখানে একরপ্রতি প্রায় ৭০মন ধান উৎপাদন হয়েছে। অন্যদিকে এ চাষে তেমন সার, কিটনাশষ ও পানির খরচ না থাকায় বিনাধান-১১ এর উৎপাদন ব্যায় খুবই কম। ফসল উঠতে সময় কম লাগায় এ জমিতেই এখন চৈতালী ফসল চাষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। এ ধান চাষের অন্যতম সুবিধা হলো এগুলি একদিকে যেমন উচ্চ ফলনশীল অন্যদিকে গাছ বেশকিছুদিন পানির তলে তলিয়ে গেলেও নষ্ট হয়না। ফলে বাড়তি পাওনা হিসেবে গবাদি পশুর খাবার হিসেবে প্রচুর খড় পাওয়া যায়। ফসলের পাশাপাশি যা এখন অতি উচ্চমূল্যে বিক্রয় করা হয়।
মাগুরা বিনা উপকেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ শেফাউর রহমান জানান- দেশে প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ লাখ হেক্টর জমি আকস্মিক বণ্যার পানি অথবা অতি বৃষ্টি জনিত জলাবদ্ধতায় ডুবে ব্যাপক ফসল হানি ঘটে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য বাংলাদেশ পরমানু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিনা) উদ্ভাবন করেছে বিনাধান-১১ জাতের উচ্চ ফলনশীল বন্যাসহিষ্ণু ধান। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় পতিত জমিতে এ জাতের ধানের চাষকে উৎসাহিত করতে বিনা ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বিনা মাগুরা উপকেন্দ্রের আয়োজনে বৃহস্পতিবার বিকেলে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ঘুল্লিয়া গ্রামে কৃষকদের বিনাধান চাষে উৎসাহিত করতে অনুষ্ঠিত হয় মাঠ দিবস।
জাতটি আবাদের সুবিধা বলতে গিয়ে বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, জাতটিতে রয়েছে ছয় ধরনের সুবিধা। প্রথমত, বন্যাপ্রবণ বা পাহাড়ি ঢলপ্রবণ এলাকায় ধান নষ্ট হওয়ার শঙ্কা নেই। কারণ এটি দীর্ঘদিন জলমগ্নতা সহ্য করতে পারে। দ্বিতীয় বড় সুবিধা হলো, প্রচলিত জাতের ধানের উৎপাদন যেখানে ১৪০ থেকে ১৫০ দিন লাগে, সেখানে এই ধান উৎপাদনে সময় লাগে মাত্র ৮০ থেকে ৯০ দিন। বীজতলাসহ সর্বোচ্চ ১২০ দিন। এই সময়টা কৃষক সরিষা, মসুর বা শাকজাতীয় ফসল উৎপাদন করতে পারবেন। তৃতীয় সুবিধা হলো, এ ধানের বীজ কৃষক নিজেই সংরক্ষণ করতে পারেন। বাজার থেকে কিনতে হয় না। অর্থাৎ কৃষকের বীজের খরচ লাগে না। চতুর্থত, আমাদের আমনের গড় ফলন যেখানে হেক্টরপ্রতি আড়াই টন, সেখানে বন্যামুক্ত স্বাভাবিক পরিবেশে হেক্টরপ্রতি এ জাতের ধান হয় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টন। বন্যা আক্রান্ত হলেও সাড়ে চার টন পর্যন্ত উৎপাদন হবে। পঞ্চমত, জীবনকাল কম হওয়ায় উৎপাদন খরচও কম। অক্টোবরের দিকে গো-খাদ্যের সংকট দেখা দেয়। এই জাতের ধান আবাদে দ্রুত ফলন হয় বলে এ থেকে খড় পাওয়া যায় দ্রুত। এতে গোখাদ্যের সংকট অনেকটাই দূর হয়। ষষ্ঠ সুবিধা হলো সার্বিকভাবে ধানের উৎপাদন ও দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা যায়। এতে দেশে ফসলের উৎপাদন বাড়বে।Magura Bina Dhan News pic 2
মাগুরা বীনা উপকেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ শেফাউর রহমানের সভাপতিত্বে এ মাঠদিবসে প্রধান অতিথি ছিলেন পরমানু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ময়মনসিংহের মহা-পরিচালক ড. মির্জা মোফাজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন মাগুরা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক সুশান্ত কুমার প্রামানিক, মাগুরা জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনিসুর রহমান খোকন, জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার ড. মো: মোশাররফ হোসেন, মহম্মদপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ আব্দুস সোবহান, মাগুরা বিনা উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোছা. রোকাইয়া সুলতানা, সৈয়দ তানভীন আবিরসহ অন্যরা। বক্তারা কৃষকদের জন্য লাভজনক বিভিন্ন জাতের সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষক তথা দেশের উন্নয়নে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

রূপক / মাগুরা /১২ নভেম্বর ২০২১