মাগুরার গণ মানুষের প্রিয় নেতা সৈয়দ আতর আলীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আগামী ১৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার। মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী যুদ্ধের ময়দানে কাজ করতে করতে অসুস্থ্য হয়ে মারা গেছেন। শহীদ হয়েছেন সৈয়দ আতর আলী। নিজের জীবন দিয়ে তিনি  এঁকে দিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের চিত্রপটকে স্বাধীনতার এক অমর চিত্রকথা। তার মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে মাগুরাবার্তার  জন্য তারই সুসন্তান সৈয়দ নাজমুল হাসান লোভনের লেখা বাবাকে নিয়ে নিবন্ধ – 

সৈয়দ নাজমুল হাসান লোভন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
মরহুম সৈয়দ আতর আলী আমার পিতা। যার রক্ত আমার শরীরে বহমান। আমি যার উত্তরাধিকারী। সেই কবে আমি প্রিয় পিতাকে হারিয়েছি। বয়সে আমি তখন কেবলই এক কিশোর বালক। ঐ বয়সেই পিতাকে হারিয়ে তাকে পরিপূর্ণ ভাবে চেনার আগে তার স্নেহ বঞ্চিত হলাম। স্বভাবতই পিতার সাথে খুব বেশী স্মৃৃতি আমার নেই। তবে যেটুকু আছে সেটা মহামূল্যবান। সেই স্মৃতি আমার আদর্শ, আমার চলার পথের শক্তি। পিতার মুগ্ধ মোহনীয় চরিত্র-আমকে প্রতিনিয়ত আপ্লুত করে।

১৯৭১ সাল। সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে পিতা তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘর-সংসার ত্যাগ করলেন। স্ত্রী-সন্তান সবই যেন তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল। যুদ্ধের মধ্যে পিতা তাই রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে চলে গেলেন। প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে তিনি একাধারে ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরে পলিটিক্যাল কনভেনর এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের (যশোর জেলা শাখা) কনভেনরের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে পালনের পাশাপাশি দেশমাতৃকার স্বাধিনতার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। শরণার্থীদের বর্ডার স্লিপ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য তরুণ প্রজন্মকে সংঘটিত করেছেন। কিন্তু নিজের দিকে ফিরেও তাকাননি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ ও সাহস যোগাতে ছুটেছেন দিনের পর দিন। নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু তিনি আর ফিরলেন না। পিতা ফিরে না এলেও তিনি রয়ে গেলেন মানুষের হৃদয়ে। রেখে গেলেন এক অন্যরকম মুগ্ধতা। দেশপ্রেম, সততা, মানুষের প্রতি ভালবাসা । মাগুরাতে তাই সৈয়দ আতর আলী নামটি বড্ড বেশী জীবন্ত হয়ে আছে। মাগুরাবাসীর কাছে নামটি সীমাহীন মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবীণ থেকে নবীণ সবার কাছেই এ নামটি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও নমস্যের।

তাঁকে নিয়ে দিন রাত্রি লিখলেও শেষ হবে না। মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙ্গালীর সকল আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। মুক্তমনের একজন মানুষ হিসেবে, আজন্ম বাঙ্গালী হিসেবে তিনিও বঙ্গবন্ধুর সারথী হয়েছিলেন তারুণ্যেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করেই পথ চলেছেন। সেই পথ চলতে গিয়ে তার ত্যাগ, অবদান অসামান্য। জীবনের শেষ দিনটিও ছিল তার দেশের জন্য নিবেদিত। রাজনীতি দিয়ে তিনি মানুষকে আপন বন্ধনে বাধঁতে পেরেছিলেন। তার রাজনৈতিক শক্তি ছিল অপরিসীম। পিতাকে কথামালা দিয়ে মূল্যায়ণ করা সম্ভব নয়। তার সততা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস-তার রাজনৈতিক জীবনকে কেবলই মহিমান্বিত করেছে। ভীষণ রকম গণমুখী মানুষ ছিলেন তিনি। চলার পথে শত মানুষের সাথে কথা বলতেন। কুশল বিনিময় করতেন, তিনি কখনোই পেশী শক্তি ও মিথ্যার কাছে মাথা নত করেননি। ধনী-দরিদ্র কোন ভেদাভেদ ছিলনা। বরং দরিদ্র মানুষের সংসারের খোঁজ-খবর তিনি একটু বেশীই রাখতেন। আর এ কারণেই দরিদ্রজনের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সাধ্যমত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। রাজনীতি করেছেন সেবা আর ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত সামনে রেখেই। বিত্তবৈভব তাকে কখনোই আকৃষ্ট করেনি।
মনে পড়ে আমাদের বাড়িতে প্রায়শই আওয়ামী লীগের সভা হতো। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। দলকে সংঘটিত করতে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুনে অনেকেই এসে আওয়ামী লীগের পতাকা তলে সমবেত হয়েছেন। প্রায় সারাদিনই তিনি দলীয় কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আমাদের বাড়ীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও অন্যান্য দলের নেতারাও আসতেন নিয়মিত। রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠেছিল আমাদের কাঠাল তলার বাঁশেরsyed-ator-ali বেড়া দেয়া ও শনের ছাউনি দেয়া কাচারি ঘরটি।

আব্বার কথা লিখতে গিয়েও মাকেও বিশেষভাবে মনে পড়ছে। বাবার রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গড়ে উঠার পেছনে মায়ের অবদান নিছক কম ছিলনা। মাগুরা জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে তিনি বাবার পাশাপাশি কাজ করে গেছেন নিভৃতে।  নারীদেরকে রাজনীতিতে সচেতন করে গড়ে তুলতে তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। এতোবড় একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের তিনি স্নেহ, মায়া-মমতা দিয়ে সেবা যত্ন করে গেছেন। আব্বা বুঝতেন তার সকল কর্মকান্ডে মায়ের ভূমিকার কথা। সেকারণে মায়ের সঙ্গে কখনোই উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি আব্বাকে। ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল তাঁর। কবি নজরুল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় কবি ছিলেন। তিনি প্রায়শই ‘মসজিদের ঐ পাশে আমায় কবর দিও ভাই’- গানটি গুন গুন করে গাইতেন এবং বিদ্রোহী কবিতাটি জোরে জোরে আবৃত্তি করতেন।

সাধারণ মানুষের জন্য সৈয়দ আতর আলীর অবদান কতটা ইতিহাসই মূল্যায়ণ করবে। তবে তাঁর সন্তান হিসেবে এটুকু বুঝি রাজনীতিতে সততা, সর্বোচ্চত্যাগ, দেশপ্রেমের যে সুরভি ছড়িয়ে গেছেন তা নিঃশেষ হয়নি। আর তাই এখনো মানুষ তাকে স্বরণে আনে ভক্তি ও ভালোবাসায়। মানুষের ভালোবাসাই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন। আমি আমার পিতাকে হারালেও, আমি আমার পিতার মূখোচ্ছবি দেখতে পাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশের সবুজ শ্যামলীমার মাঝে, স্বাধীন বাংলার পতাকার মাঝে, যারা বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কঠোর পরিশ্রম করে র‌্যামিটেন্স পাঠিয়ে দেশ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন তাদের মাঝে, গার্মেন্টসকর্মীদের মধ্যে, সর্বোপরি একটি সুখি-সমৃদ্ধশালী অসাম্প্রদায়িক, তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল সোনার বাংলা গড়ার কারীগরদের মাঝে।

লেখক : বিশিষ্ট ক্রিড়াবীদ ও শহীদ সৈয়দ আতর আলীর সন্তান

 

সম্পাদনা: রূপক আইচ, ১২ অক্টোবর ১৬