অরুন শীল, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।জয় জয় দেবী চরাচর সারে,কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।এই মন্ত্রের আবাহনে শিক্ষার্থীরা বরণ করে নেবে দেবী সরস্বতীকে। সনাতন সম্প্রদায় বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী হিসেবে মা সরস্বতীর পূজা করে থাকেন। প্রতি বছরের মত এবারও  দেশের বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে মন্ত্র উচ্চারণ করে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ, আরতি-আরাধনা, প্রসাদ আস্বাদন ও নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাণী অর্চনা পালিত হবে। সনাতন শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত।

উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন খুব ভোরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্র-ছাত্রীদের নিজ গৃহ ও সার্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃ তর্পণের প্রথাও প্রচলিত আছে। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সার্বজনীন পূজামণ্ডপগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে। পূজার ইতিহাস : সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতা ও দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। ইংরেজি বিদেশি ভাষা হওয়ায় সরস্বতী পূজার দিন ইংরেজি বইয়ে পূজা নিষিদ্ধ ছিল। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। পূজার বিধি-বিধান : শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায়। দেবী সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। এগুলো হল : অভ্র বা আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে ছাত্র-ছাত্রীরা পূজার পূর্বে কুল বা বড়ই খেতে পারেন না। পূজার দিন কিছু লেখাও নিষিদ্ধ। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, দোয়াত-কলম, পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। পূজামণ্ডপে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়। পূজার পরদিন চিড়া ও দই মিশ্রিত করে দধিকরম্ব বা দধিকর্মা দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে। দেবী সরস্বতী আসলে কে আমরা যে দেবী সরস্বতীকে হিমালয়কন্যা পার্বতীর কন্যা ও লক্ষ্মী-কার্তিক-গণেশের সহোদরা ভগ্নীরূপে দেখি,সেটা নিতান্তই বাঙালিদের ঘরোয়া মনগড়া গল্প, এর পিছনে কোন শাস্ত্রীয় অনুমোদন নেই। সরস্বতী সৃষ্টিদেবতা ব্রহ্মার সহধর্মিণী এবং বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মী ও মহেশ্বরজায়া পার্বতীর সঙ্গে একযোগে ত্রিদেবী নামে পরিচিতা। সরস্বতী প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদসমূহের প্রসূতি। ঋগ্বেদে বাগ্দেবী ত্রয়ীমূর্তি – ভূ: ভুব:স্ব:, জ্ঞানময়ীরূপে সর্বত্রব্যাপিনী।বিশ্বভূবন প্রকাশ তারই জ্যোতিতে।হৃদয়ে সে আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্বলিত হয়, তখন জমাটবাধা অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার যায় দূর হয়ে। অন্তরে, বাইরে সর্বত্র তখন জ্বলতে থাকে জ্ঞানের পুণ্য জ্যোতি। এই জ্যোতিজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্যোতিই সরস্বতী। আলোকময়ী, তাই তিনি সর্বশুক্লা। তিন গুণের মধ্যে তিনি সত্ত্বগুণময়ী, অনন্ত জ্ঞানময় ঈশ্বরের বাক্শক্তির প্রতীক বাগ্দেবী। গতিময় জ্ঞানের জন্যই ঋগ্বেদে তাঁকে নদীরূপা কল্পনা করা হয়েছে,যিনি প্রবাহরূপে কর্মের দ্বারা মহার্ণব বা অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন। কল্যাণময়ী নদীতটে সাম গায়কেরা বেদমন্ত্র উচ্চারণে ও সাধনে নিমগ্ন হতো। তাদের কণ্ঠে উদ্গীত সাম সঙ্গীতের প্রতীকী বীণা দেবীর করকমলে। সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত ভূমি বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত আশ্রয় করে সাধনা করতে আশ্রমবাসী ঋষিগণ। সেই ভাবটি নিয়েই দেবী ‘পুস্তক হস্তে’, গ্রন্থ রচনার সহায়ক লেখনীটিও তাঁর সঙ্গে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী।16426069_1260476230706740_3952247095532375146_n

এ মূর্তি অষ্টভূজা – বাণ,কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘন্টা ছিল তাঁর অস্ত্র। তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্ত জ্ঞানের ভাবটি হানি ঘটেনি, কেননা তিনি ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা’ বলে মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন। স্কন্দ পুরাণে প্রভাসখণ্ডে দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনী বর্ণিত আছে। বায়ু পুরাণ অনুযায়ী কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র কর্তৃক সংহৃত পুনর্বার প্রজাসৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন। সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার প্রজাসৃষ্টি সূচনা। গরুড় পুরাণে সরস্বতী শক্তি অষ্টবিধা। শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, কলা, মেধা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও স্মৃতি। তন্ত্রে এই অষ্টশক্তি যথাক্রমে যোগ, সত্য, বিমল, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা। তন্ত্র শাস্ত্রমতে সরস্বতী বাগীশ্বরী অং থেকে ক্ষং পঞ্চাশটি বর্ণে তাঁর দেহ। আবার পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভ িতা শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপ না শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চি তা শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষ িতা ইত্যাদি। এর অর্থ দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র- পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেতরুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী,শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা। ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভূজা অথবা চতুর্ভূজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা সরস্বতী পূজিত হন।ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভূজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা। রাজহংস কেন সরস্বতীর বাহন? কেননা জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই হাঁসের সমান গতি, যেমন জ্ঞানময় পরমাত্মা সর্বব্যাপী – স্থলে, অনলে, অনিলে সর্বত্র তাঁর সমান প্রকাশ। হংস জল ও দুধের পার্থক্য করতে সক্ষম। জল ও দুগ্ধ মিশ্রিত থাকলে হাঁস শুধু সারবস্তু দুগ্ধ বা ক্ষীরটুকুই গ্রহণ করে, জল পড়ে থাকে। জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রেও হংসের এ স্বভাব তাৎপর্য বহন করে। সংসারে নিত্য ও অনিত্য দুটি বস্তুই বিদ্যমান। বিবেক বিচার দ্বারা নিত্য বস্তুর বিদ্যমানতা স্বীকার করে তা গ্রহণ শ্রেয়, অসার বা অনিত্য বস্তু সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। হাঁস জলে বিচরণ করে কিন্তু তার দেহে জল লাগে না। মহাবিদ্যা প্রতিটি জীবের মধ্যে থেকেও জীবদেহের কোন কিছুতে তাঁর আসক্তি নেই, তিনি নির্লিপ্তা। হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন সরস্বতী।গান্ধারে পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে। অনেক বৌদ্ধ উপাসনালয়ে পাথরের ছোট ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, অবিকল সরস্বতীমূর্তি। মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই।শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদন ছিল। জৈনদের চব্বিশজন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতমা হলেন সরস্বতী। শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর উভয় জৈন সম্প্রদায়েই সরস্বতীর স্থান হয়ে গেল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীতা একজন প্রধান দেবীরূপে। সরস্বতী শব্দের দুই অর্থ  একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী। সরস্ +বতী = সরস্বতী, অর্থ জ্যোতির্ময়ী। আবার সৃ ধাতু নিস্পন্ন করে সর শব্দের অর্থ জল। অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী।ঋগ্বেদে আছে ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’,সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। শুধু বৈদিক যুগেই নয়, পরবর্তীকালে মহাভারত, পুরাণ, কাব্যে পূতসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে।

মাগুরা/১ ফেব্রুয়ারী১৭