মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের ভাবনপাড়া গ্রামে তুলা চাষ করেছেন পবিত্র কুমার সাহা (৫৫)। বাড়ির আসপাশে নিজের পতিত জমি আছে কিন্তু অন্য ফসল তেমন না হওয়ায় সংসার চলত না।
অভাবে পড়ে বাড়ির গাছ গবাদিপশু বিক্রি করে দেনএক সময় । এ সময় একদিন শুনলেন পতিত জমিতে তুলা চাষের কথা। তিনিও শুরু করলেন তুলা চাষ। এখন তিনি স্বচ্ছল কৃষক। তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে এলাকার অনেক কৃষকই তুলা চাষ করে অভাব তাড়িয়েছেন।
মাগুরা তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পাঁচটি কটন ইউনিট অফিসের মাধ্যমে জেলার এক হাজার ৬০০ কৃষক তুলা চাষ করে লাভবান হয়েছেন। তুলা চাষ বদলে দিয়েছে কৃষকদের জীবন মান। তাদের দিন বদলের গল্প এখন সবার মুখে মুখে।
সম্প্রসারিত তুলা চাষ প্রকল্পের (ফেজ- ১) আওতায় এসব কৃষকদের তুলা চাষে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে এক সময়ের তুলা চাষের জন্য বিখ্যাত মাগুরার হারানো গৌরব আবার ফিরে আসছে।
তুলা চাষের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মাগুরা তুলা চাষের জন্য সম্ভাবনাময়। জেলার পতিত জমিতে তুলা চাষ করে বছরে কয়েক কোটি মার্কিন ডলার আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব। এজন্য কৃষকদের তুলার চাষ বৃদ্ধির আহ্বান জানান।
জেলা তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তিনজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ঝিনাইদহ জোনের অধিনে মাগুরা সদর, শ্রীপুর, শালিখা ও মহম্মদপুর উপজেলায় তুলার আবাদ হচ্ছে। এ এলাকার মাটি তুলা চাষের অত্যন্ত উপযোগি। একসময় এসব এলাকায় প্রচুর তুলার আবাদ ছিল। নানা কারণে কৃষক তুলা চাষে আগ্রহ হারায়। তুলা উন্নয়ন বোর্ড কৃষকদের আবার তুলা চাষে ফেরানোর উদ্যেগ নিয়ে সফলও হয়েছে। magura cotton cultivation picture 3
মাগুরা সদর, ইছাখাদা, আলোকদিয়া, শ্রীপুর ও লাঙ্গলবান্দ এলাকায় কটন ইউনিটের অফিস রয়েছে। এসব অফিসে একজন করে কটন ইউনিট অফিসার ও মাঠকর্মী কাজ করছেন।
চলতি মৌসুমে পাঁচটি ইউনিটের প্রতিটিতে ২০০ হেক্টর করে এ হাজার হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ করা হয়েছে। এক হাজার ৬০০ জন চাষিকে নিবিড় তুলা চাষ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। তুলা চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন এসব চাষিরা। খরচের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ লাভ হয় বলে তুলা চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের।
প্রতিটি কটন ইউনিটে তিনটি থেকে পাঁচটি প্রদর্শনী প্লটে রুপালি-১, সিবি-১২, সিবি-১৩ ও সিবি-১৪ জাতের তুলা চাষ করা হয়েছে। চাষিদের বিনা মূল্যে সার, কীটনাশক ও বীজ সরবরাহ করা হয়। বড় চাষীদের দেওয়া হচ্ছে সহজ শর্তে ঋণ। তুলা উন্নয়ন বোর্ড চাষিদের উৎপাদিত তুলা বাজারজাত করার নিশ্চয়তাও দিয়ে থাকে।
বছরের আগস্ট মাসে তুলার বীজ রোপন করা হয় জানুয়ারির শুরুতে খেত থেকে তুলা সংগ্রহ করা হয়। এক বিঘা জমিতে তুলা চাষ করতে খরচ হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। উৎপাদন হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি। এই পরিমাণ তুলা বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়।
তুলা থেকে বীজ ছাড়ানোর (জিনিং) কুষ্টিয়াভিত্তিক সাতটি মিলের মালিকদের সংগঠন কটন জিনার্স এ্যাসোসিয়েশন কৃষকদের কাছ থেকে তুলা কিনে নেয়। সরকারও সরসরি কিছু তুলা কেনে।
মহম্মদপুরের বিনোদপুর ইউনিয়নের ভাবনপাাড়া, তল্লাবাড়িয়া ও রাজাপুর ইউনিয়নের নাওভাঙ্গা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ জমিতেই রবিশস্যের চাষ করেছেন কৃষকেরা। সেখানে খেতের পাশেই দেখা গেল তুলার দুটি প্রদর্শনী প্লট। খেত থেকে তুলা তুলছিলেন ভাবনপাড়া গ্রামের কৃষক পবিত্র কুমার সাহা ও তার স্ত্রী শেফালী রানি সাহা।
পবিত্র কুমার সাহা বলেন, ‘আমাদের বাড়ির এসময় জমি এবছর আগেও পতিত পড়ে থাকত। তুলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে তুলা চাষ করার প্রস্তাব দিলে রাজি হই। তুলা চাষে কম পরিশ্রমে বেশি আয় হয়। তা ছাড়া জমি এবং পরিবেশেরও ক্ষতি হয় না।’
একই এলাকার মজিদ মন্ডল ও সালাম শিকদার বলেন, ‘আমরা দুটি প্লটে দুই বিঘা জমিতে তুলা চাষ করেছি। চাষে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হবে তুলা বিক্রি করে।’
মাগুরা সদর উপজেলার মঘি ইউনিয়নের মহিষডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল মান্নান মৃধা ৫০ শতক জমিতে তুলার আবাদ করেছেন। ২০-২৫ মণ তুলা পাবেন। প্রতিমণ কাচা তুলা বিক্রি হয় দুই হাজার ২০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা দরে।’
চাউলিয়া ইউনিয়নের শ্রীকুন্ডি গ্রামের স্বপন কুমার দে জানান,‘তিনি দশ বছরেরবেশি সময় তুলা চাষ করছেন। অন্য ফসলের মতো তুলা বিক্রি করতে বাজারে যেতে হয় হয় না। মিল মালিকরা বাড়ি থেকে তুলা কিনে নিয়ে যান।’
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের ৩৬৩টি সুতাকলে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ বেল আঁশতুলার চাহিদা রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী তুলার উৎপাদন না হওয়ায় প্রতিবছর প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার আঁশতুলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ জন্য তুলার উৎপাদন বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড। পাশাপাশি যেসব এলাকায় তামাকের মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ফসল চাষ হয়, সেসব এলাকার চাষিদের তুলা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
মাগুরার প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল কবির জানান, ‘গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক তুলা চাষে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করতেই আমাদের এই কর্মসূচি। এ বছর জেলায় তুলার ফলন ভালো হয়েছে। এ এলাকায় বীজতুলা উৎপাদনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।’
২২ জানুয়ারি ২০১৭