আজ ১৪ই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এ বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী  ডা. ক্যাপ্টেন এ কে এম ফারুক এর ছবি সম্বলিত একটি ডাকটিকেট   উন্মোচন করেছেন সরকার । জনাব একেএম ফারুক মাগুরায় দীর্ঘদিন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক হিসেবে দায়িত্বে থাকা জনপ্রিয়  অফিসার জনাব এ কে এম তারেকের পিতা। জনাব তারেকের স্ত্রী আকতারী শিফা তার ফেসবুকে শ্বাশুড়ির বরাত দিয়ে  না দেখা সেই প্রিয় মানুষ (শ্বশুরকে) কে নিয়ে একটি আবেগঘন লেখা লিখেছেন। তার লেখাটি মাগুরাবার্তার পাঠকদের জন্য তুলে দেয়া হলো-

আমার বাবা ( শ্বশুড়) চলে গেছেন, না ফেরার দেশে, ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চে। কিভাবে উনাকে মেরে ফেলা হয়েছে আমরা কেউই তা জানি না। তাই এখনো আমরা তাঁর আসার আশা ছাড়িনি।
বাবা ডাক্তার ছিলেন বিধায় অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার কথা বলে ধরে নিয়ে যেতে খুব সুবিধা হয়েছিল পাকিস্তানিদের। তাই বলে যুদ্ধের শুরুর দিকেই??? মার্চের ৩০ তারিখেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল জলপাই রঙ এর জিপ এসে। তখন উনারা ( বাবা, মা, তারেক) কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এর বাসায়। নাস্তা খেতে বসেছিলেন, নাস্তা আর শেষ করা হলো না। 12342331_1638966413020499_5162289744728554373_nবাবা উঠে চলে গেলেন। সেই যাওয়াই যাওয়া — আর ফিরে এলেন না। শুধু দুপুরে একবার কথা হয়েছিল মায়ের সাথে। বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর অসহায় মা, ছয় মাসের ছেলেকে বুকের মধ্যে ধরে রেখে সারাক্ষণই কলিং বেল আর একটা ফোনের অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ দুপুরের দিকে বাবার ফোন এলো, “আমরা ভালো আছি, তোমরা ভালো থেকো।” মা কিছুই বলতে পারলেন না, তার আগেই ফোনটা কেটে গেল। মা কি বলতে চেয়েছিলেন, বা বাবাই বা কি বলতে চেয়েছিলেন —– কিছুই বলা হলো না।

“বাবাকে কি ওরা পিছমোড়া করে হাত বেঁধে রেখেছিল, যখন মেরেছিল তখন কি চোখ বেঁধে নিয়েছিল” – মা, অসংখ্যবার আমাকে জিজ্ঞাস করেছেন। তখন না জানি তোমার বাবার কেমন লগেছিল, না জানি তখন কার মুখটা ভেসে উঠেছিল………. কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন তিনি।
মা বলতেন, ” দেখো, একদিন তোমার বাবা ঠিক আসবে। এসে বলবে, এতদিন ওরা আমাকে আটকে রেখেছিল, তোমরা সবাই কেমন আছো, আমার খোকাটা কত্ত বড় হয়ে গেছে…….”। মাকে নাকি তারেক ( আমার স্বামী) ছোটবেলায় জিজ্ঞাস করতো, মা, আমার আব্বা কোথায়? মা মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিতেন, অনেক উপরে। ও বলতো, আব্বা ওখান থেকে আসে না কেন? মা বলতেন, অত বড় মই যে পৃথিবীতে নেইরে বাবা।

৪৪ বছর পর আজও সকালে ঘুম থেকে উঠে তাঁরই ছেলে একই কথা শোনালো আমাকে, “জানো, এখনও আমার মাঝে মাঝে মনেহয়, আব্বা হয়তো ফিরে আসবেন। এসে বলবেন, ওরা আমাকে আটকে রেখেছিল, তোদের মা কই……। আর আমরা বাবাকে চিনতেই পারবো না, হতভম্ব হয়ে যাবো।” ভিতরে কতটা কষ্ট জমা রেখে একজন বাবা, তার বাবা সম্পর্কে এরকম করে বলতে পারে, তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। কথাগুলো বলার সময়, ও একবারও কাঁদেনি, কিন্তু আমি চোখের জল আটকে রাখতে পারছিলাম না।

আজ শহীদ বুদ্ধিঝীবী দিবস। সেই তালিকায় বাবাও আছেন। কিন্তু, যে পাকিস্তানি বাবা ( পশু???), আরেক বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেললো, আজ সেই বাবার ছেলে কি বুঝতে পারছে যে, বাবা হারানোর ব্যাথাটা কি রকম??????????….. কক্ষনই না….

তাই, ক্ষমা….
……. কক্ষনই না……

রূপক আইচ/মাগুরা/ ১৪ ডিসেম্বর১৬