মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
মাগুরাবার্তায়   প্রথম সংবাদ প্রকাশের পর  অসহায় দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার জন্য নিজ উদ্যোগে অসহায় দরিদ্র ও প্রবীণ মানুষদের চিকিৎসা সেবা দেয়া মাগুরা সদরের খর্দ কছুন্দি গ্রামের জীবন সরকারকে সম্বর্ধনা দিয়েছে মাগুরা জেলা প্রশাসন। আজ রবিবার সকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন।  মাগুরার জেলা প্রশাসক মুহ. মাহবুবর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মাননা সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আজমল হক, পৌর মেয়র খুরশিদ হায়দার টুটুল, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব রুস্তম আলীসহ জেলার বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান ও সাংবাদিকবৃন্দ। গত ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে মাগুরাবার্তায়  জীবন সরকারকে নিয়ে-

আজীবন মানুষের সেবায় কছুন্দির ‘জীবন ডাক্তার’

শিরোনামে মাগুরাবার্তায়  প্রথম বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সংবাদটি মাগুরা জেলা প্রশাসনের গোচরিভুত হওয়ার পর জেলা প্রশাসকের আয়োজনে এ সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়।dc-1

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জীবন সরকারকে ৫হাজার টাকার চেক ও ক্রেস্ট উপহার দেয়া হয়।  ১ অক্টোবরে প্রকাশিত ওই সংবাদটি ফেসবুকে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। প্রায় ১হাজার লাইক শেয়ারসহ হাজার হাজার মানুষ নিউজটি পড়ে মাগুরাবার্তাকে  শুভেচ্ছা জানান।

সম্বর্ধনা সভায় জেলা প্রশাসক মুহ. মাহবুবর রহমান বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক নিবেদিত প্রাণ মানুষ আছেন যারা মানুষের উপকারের জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছেন। তেমনি একজন মানুষ জনাব জীবন সরকার। তাকে সম্মানিত করতে পেরে আজ জেলা প্রশাসন সম্মানিত হয়েছে। এমনি হাজার জীবন সরকার হোক মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ কাজ করার অনুপ্রেরণা।

জীবন সরকার তার বক্তব্যে বলেন- কোনদিন কিছু পাওয়ার আশায় মানুষের চিকিৎসা করিনি। মানুষের মাঝেই আমি ঈশ্বরকে খুঁজে পাই। অসহায় মানুষ যখন অসুস্থ্য হয়ে কষ্ট পান। তখন মনে হয় ঈশ্বর কষ্ট পাচ্ছেন। তাই অসহায় দরিদ্র মানুষের সেবা করেই আমি ঈশ্বরের সেবা করতে চেষ্টা করি। আমৃত্যু যেন এই সেবা করে যেতে পারি সকলের কাছে সেই আশির্বাদ কামনা করি।

১ অক্টোবরে প্রচারিত সংবাদটি নিচে দেয়া হলো………..

http://magurabarta24.com/7519-2/

আজীবন মানুষের সেবায় কছুন্দির ‘জীবন ডাক্তার’

file

মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে’ সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করে এ কথা বাস্তবে সত্য করেছেন তিনি ।

১ অক্টোবর সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রবীন দিবস।

মাগুরা সদরের খর্দকছুন্দি গ্রামের  চুরাশি বছরের প্রবীন জীবন কৃষ্ণ সরকারের বিশ্ব প্রবীন দিবস সস্পর্কে তেমন কোন ধারনা নেই। তবে এলাকার প্রবীন মানুষের জন্য তার রয়েছে এক সহজাত ভালবাসার সম্পর্ক। তবে নিজেকে প্রবীণ বলতেও রয়েছে আপত্তি। এই বয়সেও গ্রামের মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলাই তার কাজ। গ্রামের চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের চিকিৎসার পাশাপশি স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের চর্চা করতে পালন করে যাচ্ছেন অনন্য ভূমিকা।

প্রবীন এ মানুষটি পায়ে হেটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ ও শিশুদের চিকিৎসা সেবা দেন। একনাগাড়ে ষাট বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এই কাজটি করে যাচ্ছেন। গ্রামের প্রবীণ অসহায় দরিদ্র মানুষের পরম বন্ধু তিনি। এলাকায় তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। জীবন ডাক্তার বললে একনামে সবাই চেনেন তাকে। জীবন কৃষ্ণ সরকারের বাড়ি মাগুরার সদর উপজেলার কছুন্দি ইউনিয়নের খর্দকছুন্দি গ্রামে।
‘আমি নিজেকে একজন ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিতে আগ্রহী না ; বরং আমি খুশি যদি মানুষ আমাকে দারিদ্র্যপীড়িত ও অসহায়ের ‘সেবক’ বলে ডাকেন। আমার কাজ দুর্দশাগ্রস্ত বয়স্ক মানুষের সেবা দান, যাতে তারা অন্তত সুস্বাস্থ্য নিয়ে দিন পার করতে পারেন।’- বললেন জীবন কৃষ্ণ সরকার।

৩০সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টা। জীবন কৃষ্ণ সরকারের বাড়ির সন্ধানে বের হই। খুব ভোরে বাড়ি না পৌছাতে পারলে তাকে পাওয়া যাবে না- আগেই জানাছিল । মোবাইল ব্যবহার না করায় গ্রামে বের হয়ে গেলে সন্ধ্যার আগে আর পাওয়া যাবে না।

মাগুরা জেলা সদর থেকে কছুন্দি ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে খর্দকছুন্দি গ্রাম আরও কয়েক কিলোমিটার ভিতরে। বাড়ি খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হয়নি। জীবন ডাক্তার বলতেই যে কেউ চেনেন তাকে।

জীবন সরকার একাই বসবাস করেন ছয় শতক জমির এই পৈত্রিক ভিটায়। জমিজমা বলতে এইটুকুই।

বাঁশের বেড়া আর টিনের ছাউনির জীর্ণ বসতঘর। মাটির বারান্দার এক কোনায় চুলায় ধোয়া তুলে রান্না করছেন তিনি।

সংবাদকর্মী পরিচয় দিলে এগ্রিয়ে আসেন তিনি। তিনি জানান, ‘অল্প বয়সে বাবা- মা হারান জীবন সরকার। মাত্র সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন। দারিদ্রতার কারণে বিয়ে করেননি।
ছোট বেলায় যশোর শহরের এক এমবিবিএস ডাক্তারের সহকারি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৫ বছর ডাক্তারের সহচার্যে থেকে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসার উপর জ্ঞান অর্জন করেন।
এরপর দরিদ্রপীড়িত কছুন্দি গ্রামে ফিরে এসে বাড়িবাড়ি ঘুরে সাধারণ মানুষের রোগব্যাধির চিকিৎসা দিতে থাকেন। মানুষকে সচেতন করেন স্বাস্থ্য রক্ষার নানা বিষয়ে। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি পরিচিতি পান জীবন ডাক্তার নামে।’
খর্দকছুন্দি গ্রামের স্কুল শিক্ষক আসগর আলী মাগুরাবার্তাকে  বলেন, ‘জীবন ডাক্তার আমাদের বিপদের বন্ধু। বাড়ি বাড়ি ঘুরে তিনি খোঁজ নেন কারও কোন সমস্যা আছে কিনা। পেটে ব্যাথা, জ্বর, পেটেরপীড়াসহ নানা সাধারণ অসুখের তিনি ওষুধ দেন। উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় ও স্টেথিস্কপ দিয়ে হৃদযন্ত্রের অবস্থা জানিয়ে দেন তিনি। পাশ করা বড় ডাক্তার না হলেও তার অসুখ-বিসুখ নিয়ে রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। যেকোন অসুখের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন তিনি। খারাপ কিছু হলে তিনি আগেই জানতে পারেন। রোগিকে সঠিক চিকিৎসার জন্য বড় ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেন।’
শেওলাডাঙ্গা গ্রামের বিধবা নারী অমলা বিশ্বাস মাগুরাবার্তাকে বলেন,‘২৮ বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন তিনি। দারিদ্রতার কারণে তারপক্ষে শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয় না। জীবন ডাক্তার প্রতি সপ্তাহে এসে তার খোঁজ নেন। ওষুধ দিয়ে যান। ওষুধের দামটা নেন। আর কোন টাকা নেন না। প্রতিদিন এরকম অসংখ্য মানুষের পাশে দাড়ান তিনি।’
কছুন্দি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বাকি বিল্লাহ সান্টু মাগুরাবার্তাকে  বলেন, ‘এলাকার সবার প্রিয় মুখ জীবন ডাক্তার খুব ভোরে নিজে রান্না করে খেয়ে বাড়ি থেকে বের হন। ইউনিয়নের খর্দকছুন্দি, আড়পাড়া, বাগবাড়িয়া ও পাতুরিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে তিনি পায়ে হেটে ঘুরে বেড়ান। অসুস্থ লোকজনের সন্ধান করে চিকিৎসা দেন। তার ব্যাগে সবসময় থাকে জরুরী ওষুধ, একটি রক্তচাপ পরিমাপের যন্ত্র, থার্মোমিটার ও একটি স্টেথিস্কপ।
স্থানীয় কলেজ শিক্ষক শতদল বিশ্বাস মাগুরাবার্তাকে  বলেন, ‘জীবন ডাক্তারের চরিত্রের একটি বড় গুণ তিনি সবসময় অসুস্থদের পাশে থাকেন। তিনি হৃদরোগের মতো বড় অসুখ থেকে শুরু করে যক্ষ্মা (টিবি) রোগীদের পাশে দাড়িয়েছেন তিনি। রোগি সনাক্ত করে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তার নিজের খরচে মাগুরা সদর বা উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানীয় টিবি হাসপাতালে ভর্তি হতে সাহায্য করেন।’magura-dr-jibon-picture-002
দর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য গিরিশ চন্দ্র মন্ডলমাগুরাবার্তাকে জানান,‘তিনি দরিদ্র অশিক্ষিত এবং চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরিতে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। খাবার গ্রহণের আগে হাত ধোয়ার শিক্ষা কেন মানুষের জন্য অপরিহার্য’-তিনি তা হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন ৫০ বছর ধরে।’
জাতীয় পরিচয়পত্রে জীবন কৃষ্ণ সরকারের জন্ম তারিখ ০১ মার্চ ১৯৩২ ইংরেজি। এই বয়সে তার কর্মশক্তি আর মানুষকে সেবা করার স্পৃহা দেখে অবাক হন স্থানীয়রা। বড় ডিগ্রিওয়ালা চিকিৎসক হয়ত তিনি নন কিন্তু অসংখ্য দুস্থ অসহায় মানুষের প্রিয় ‘জীবন ডাক্তার’। যিনি একজন বড় ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসার জ্ঞান অর্জন করে তা মানুষের উপকোরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিঃম্বার্থভাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে অশীতিপর কৃষ্ণ সরকার মাগুরাবার্তাকে  বলেন, ‘আমার কোন আত্মিয়স্বজন নেই। এইসব গ্রামের মানুষগুলোই তার কাছের মানুষ। তাদের সুখ-দুখে পাশে থাকতে পারার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই কাজটা করে যেতে পারলেই তিনি খুশি। সবসময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তারাযেন ভালো থাকেন সুস্থ্য থাকেন।’

 

সম্পাদনা: রূপক আইচ, ০১ অক্টোবর ২০১৬