বিশেষ প্রতিনিধি, মাগুরাবার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
ডাক্তার মুক্তাদির রহমান। পদ তার আবাসিক মেডিকেল অফিসার। নিয়মানুযায়ী বসবাস করার কথা হাসপাতাল কম্পাউন্ডের সরকারি বাসায়। কিন্তু নিয়ম ভেঙ্গে তিনি বসবাস করেন হাসপাতাল ক্যাম্পাসের বাইরে। অফিস সময়ে কর্মস্থলে আসেন ঠিকই। তবে নানা অজুহাতে মাঝে-মাঝেই ছুটে যান ক্লিনিকে। আর দুপুরের পর থেকে গভীর রাত, এমনকি শেষ রাত পর্যন্ত তো তিনি বড় সার্জন! সাধারণ মেডিকেল অফিসার হয়ে নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে শহরে নিজের প্রতিষ্ঠিত পলি ক্লিনিকে করেন একের-পর এক অপারেশন। ভাব দেখে মনে হবে পলি ক্লিনিকই তার আসল কর্মস্থল। তবে আসল কর্মস্থল সরকারি সদর হাসপাতালে তার বিরুদ্ধে রয়েছে দালাল পোষা, অনিয়ম, সেচ্ছাচারিতা, অদক্ষতা, সার্টিফিকেট বানিজ্যসহ বিস্তর অভিযোগ। অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক মনভাবাপন্ন মুক্তাদির ৭১ সালে কিশোর বয়সে ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য। সে সময় করেছেন হিন্দুর বাড়ি দখল, লুটপাটসহ স্বাধীনতা বিরোধী নানা অপকর্ম। সর্বশেষ ২৫ বছর ধরে সরকারি চাকরি ও ক্লিনিক বানিজ্যর মাধ্যমে নানা অপকর্ম করে চললেও কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে নিরব। এমনকি মাস্তান ও দালাল পোষার কারনে ক্লিনিকবাজ হিসেবে পরিচিত ডাক্তার মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে টুশব্দটি করতে সাহস করেন না শহরের কোন মানুষ। ভদ্র মানুষের লেবাসে নানা অপকর্মের হোতা ডা: মুক্তাদির এর অপকর্মে এসব তথ্য উঠে এসেছে সরকারে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও।
শহরের পিটি আই পাড়ার বাসিন্দা ঠিকাদার আরিফ শেখ মাগুরাবার্তাকে অভিযোগ করেন, আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে তার হাসাপাতাল ক্যাম্পাসের সরকারি বাসায় বসবাস করার নিয়ম থালেও তিনি দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থাকেন শহরে নিজের প্রতিষ্ঠিত পলি ক্লিনিকে। অন্য সময় থাকেন শহরতলীর নান্দুয়ালী গ্রামের বাড়িতে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অফিস আওয়ারে কর্মস্থল সদর হাসপাতালে থাকলেও মাঝে-মাঝে অপারেশন করতে ছুটে আসেন নিজ ক্লিনিকে। হাসপাতাল থেকে দালালদের মাধ্যমে রুগী পাঠান নিজের পলি ক্লিনিকে। আর দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত করেন একর পর এক আপারেশন। কোন ডিগ্রিধারী সার্জিক্যাল সার্জন নন তিনি। সাধারণ একজন মেডিকেল অফিসার হিসেবে একের-পর এক কাটা ছেড়া করেন মানুষের শরীর। ভুল অপারেশনে গত এক বছরে তার হতে অন্তত ৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবারই তিনি প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করে টাকার বিনিময়ে নিজেকে রক্ষা করেছেন।
একই এলাকার সাইফুল খানের পুত্র ব্যবসায়ী ও ছাত্রলীগ কর্মী শামীম খান মাগুরাবার্তাকে বলেন, হাসপাতালের ওষুধ, ইনজেকশন থেকে শুরু করে রক্ত পর্যন্ত চুরি করেন সদর হাসপাতালে আর এমও মুক্তাদির রহমান। ভদ্রলোকের লেবাশে তিনি একজন ভংঙ্কর মানুষ। টাকা হলে তিনি পারেন না এমন কাজ নেই।
শহরের খান পাড়ার বাসিন্দা সোহেল রানা মাগুরাবার্তাকে বলেন, বছর দুয়েক আগে তার এক নিকটজন খুন হন। তাকে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু আরএমও মুক্তাদির দুই লাক্ষ টাকার বিনিময়ে হত্যার কারণ হিসেবে দেওয়া প্রত্যায়ন পত্রে গুলি বিষয়টি এড়িয়েই যান।
জেলা ঘাতক দালাল নিমূর্ল কমিটির সাবেক সভাপতি সেলিম খান মাগুরাবার্তাকে জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের সকল অপকর্মের হোতা তিনি, নিয়ন্ত্রকও তিনি। ওষুধ চুরি, সার্টিফিকেট বানিজ্য এমনকি হাসপাতালে ঠিকাদারী পর্যন্ত তিনি নিয়ন্ত্রন করেন। অপকর্মের জন্য তাকে উকিল নোটি পাঠিয়েছেন বলে জানান সেলিম খান।
জেলা আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. সাজিদুর রহমান সংগ্রাম মাগুরাবার্তাকে বলেন, ৭১ সালে ডাক্তার মুক্তাদিরের গুষ্টি ধরে রাজাকার ছিলো। তিনি ভংঙ্কর সাম্প্রাদায়িক মানুষিকতার লোক। বর্তমানে তার কিছু পোষা দালাল আছে। যাদের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে তিনি ২৬-এর সার্টিফিকেট- এর ব্যবসা করেন। আবার একই কায়দায় প্রকৃত ২৬ কে ২৪ বানিয়ে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাগুরা শহরের একটি হিন্দু সাহা পরিবারের সদস্য মাগুরাবার্তাকে বলেন, ৭১ সালে একটি রাজাকার গ্রুপ তাদের বাড়ি দখল করে নেয়। লুটপাট চালায় ব্যাপকভাবে। যাদের মধ্যে ছিলেন সে সময়ের কিশোর ইসলামি ছাত্রসংঘের সদস্য আজকের ডাক্তার মুক্তাদির রহমান। ভদ্রলোককে দেখলে এখনো সে কথা মনে পড়ে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোল্লা নবুয়ত আলী মাগুরাবার্তাকে জানান, ৭১ সালে মুক্তাদিরের গোটা পরিবার জালেমের ভুমিকায় অবতির্ণ হয়েছিলো। দখল, লুটপাটসহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সকল কাজেই তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত ছিল। তার এক চাচাতো ভাই ছিলো অস্ত্রধারী রাজাকার। কিশোর বয়সে সে ছিলো ৭১’এর কসাই তৎকালিন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ও সম্পাদক রিজু ও কবির বাহিনীর সদস্য।
জেলা আওয়ামীরীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ কুন্ডু মাগুরাবার্তাকে বলেন, মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। সে ভয়ঙ্কর রাজাকার মানুষিকতার লোক। কেন তাকে সদর হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার একটি সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাগুরাবার্তাকে জানান, তারা সদর হাসপাতালের আরএমও মুক্তাদির রহমানের নানা অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন। তার মত ব্যক্তিকে মাগুরা সদর হাসপাতালে গুরুত্বপূণর্ ওই পদে রাখা হলে যে কোন সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। যে বিষয়টি উপর মহলকে অবিহিত করা হয়েছে।
অভিযোগের ব্যাপারে মুক্তাদির রহমানের কাছে মোবাইলে কথা বললে তিনি মাগুরাবার্তাকে বলেন, মাগুরার সব সেক্টরের মানুষ খারাপ। মাগুরার মানুষ যা চায় তাই তিনি করেন। তার বিরুদ্বে বড়-বড় নিউজ করেন তাতে কিছুই হবে না বলে ডাক্তার মুক্তাদির দম্ভোক্তি করেন।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন এফবিএম আব্দুল লতিফ মাগুরাবার্তাকে বলেন- বিষয়গুলি নিয়ে আমি মৌখিক শুনেছি। এ ব্যাপারে কোন লিখিত অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে আমি অবশ্যই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
সম্পাদনা: রূপক আইচ, ২২ সেপ্টেম্বর ১৬
সদর হাসপাতালের আরএমও’র বিরুদ্ধে অবৈধ ওষুধ ও ক্লিনিক বাণিজ্যের অভিযোগ