রূপক আইচ, মাগুরা প্রতিনিধি
আগামী ১১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মাগুরা সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের নির্বাচন। ইতিমধ্যে চলছে শেষ সময়ের প্রস্তুতি। নির্বাচন নিয়ে গত ১৫অক্টোবর সদরের জগদল ইউনিয়নে ৪খুনের প্রেক্ষিতে অবাধ,সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এসব এলাকায় এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে অধিকাংশ ইউনিয়নেরই আওয়ামীলীগের নৌকা মার্কার প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীই প্রধান মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুএকটি ইউনিয়নে বিএনপি দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও সেক্ষেত্রে তারা গোপনে আওয়ামীলীগের একটি অংশের সমর্থন নিতে সক্রিয় রয়েছেন।
কিন্তু মাগুরা সদর উপজেলার সবকটি ইউনিয়নেই চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী, বিএনপি সমর্থিত স্বতন্ত্র ও জাসদ প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে বগিয়া, হাজরাপুর ও হাজিপুর ইউনিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নিজেদের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আওয়ামী লীগ মনোনিত তিন প্রার্থী- মীর রওনক হোসেন (বগিয়া), মোজাহেরুল হক আখরোট (হাজিপুর) এবং কবির হোসেন (হাজরাপুর) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তবে বাকি ১০টি ইউনিয়নে নৌকা মার্কার প্রার্থীরা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়েছেন। নানা কারণে বেশ কয়েকটি স্থানে নৌকা এবার ডুবতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ঠরা।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ওই ইউনিয়নগুলোর মধ্যে মাগুরা সদর উপজেলার জগদল অন্যতম। আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বর পদে প্রার্থিতা নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় গত ১৫ অক্টোবর শুক্রবার বিকালে এ ইউনিয়নে এক গ্রাম্য মাতব্বরসহ ইতিমধ্যে চারজন খুন হয়েছে। মেম্বর পদের প্রার্থিতা নিয়ে নজরুল মেম্বর এবং নতুন প্রার্থি সৈয়দ আলি’র সমর্থকদের মধ্যে বেশ কয়েকদিন ধরে বাদ বিবাদ চলছিল। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিপক্ষের হামলায় কবির মোল্যা (৫৮), সবুর মোল্যা (৫৫), আবদুর রহমান মোল্যা (৪৫) এবং ইমরান (২৬) নামের চারজন খুন হয়। এ সব কারণ বিবেচনা করলে সদরের জগল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের জন্যে একটি স্পর্ষকাতর নির্বাচনী ইউনিয়ন হিসাবে দেখা দিয়েছে। এবারও সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন গতবারের বিজয়ী চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। তবে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম এবং সাবেক চেয়ারম্যান জাহিদ হাসান। এই অনাকাংখিত ঘটনার পর ইতিমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাগুরা সফর করে গেছেন। এ সময় তিনি নির্বাচন নিয়ে কোন ধরনের বিশৃংখলা কঠোর হাতে দমনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। নির্বাচনে রাঘবদাইড় ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছেন মাগুরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আশরাফুল আলম বাবুল ফকির। তিনি গতবারের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক ভোটের ব্যাবধানে বিজয়ী হলেও এবার তার প্রতিপক্ষ এ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু তালেব নান্টু। নান্টু শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ্য থাকায় নির্বাচনে তাকে মাঠে কম দেখা গেলেও এ ইউনিয়নে সামাজিক দল একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে গতবছর নির্বাচিত হওয়ার আগে ও পরে রাঘবদাইড় ইউনিয়নে প্রচুর রাস্তা, ঘাট, স্কুল কলেজ,মসজিদ,মাদ্রাসা, মন্দিরসহ উন্নয়ন কাজ করায় এবং ব্যক্তিগত সততার কারণে বাবুল ফকিরের অবস্থা বেশ শক্তিশালী। কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নে গতবারের পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী আলমগির হোসেন তুষারকে আবারও দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তার সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন গতবারের বিজয়ী মাগুরা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মো. টিপু সুলতান। সেখানে ত্রিমুখি ভোটে কে নির্বাচিত হয় এটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বেরইল পলিতা ইউনিয়নে জমজমাট ও হাড্ডা-হাড্ডি নির্বাচন হবে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় ভোটাররা। এ ইউনিয়নে গতবারের বিজয়ী আওয়ামীলীগ প্রার্থী মহব্বত আলি এবারও আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা মার্কায় নির্বাচন করছেন। তবে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এনামুল হক রাজা। পাশাপাশি বিএনপি নেতা শেখ শফিকুল ইসলামও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই তিন প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ ইউনিয়নের ত্রিমুখি লড়াই জমজমাট হয়ে উঠতে পারে বলে ভোটারদের অভিমত। তবে সরকার দলীয় প্রার্থী প্রভাব বিস্তার করার একাধিক অভিযোগ দিয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী রাজা। যদিও সোমবার আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে জনাব রাজাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। আর চাউলিয়া ইউনিয়নের গতবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান হাফিজার রহমান মোল্যাকে হারিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে চেয়ারম্যান হতে চান এ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা রেজাউল ইসলাম মাস্টার। স্থানীয় ভোটারদের সমর্থন আদায়ে ইতোমধ্যেই তিনি জনসংযোগ শুরু করেছেন। Magura sadar election Pic 2
আঠারখাদা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন গতবারের বিজয়ী চেয়ারম্যান সঞ্জিবন বিশ্বাস। তবে এ ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন ইউনিয়নের সাবেক দুই চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী বেনজির হোসেন এবং বিএনপির থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী অমরেশ চন্দ্র বিশ্বাস। পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের সমর্থন আদায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জাসদের প্রার্থী বিমল বিশ্বাস। এ অবস্থায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন নৌকা মার্কার প্রার্থী সঞ্জিবন। শত্রুজিতপুর ইউনয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান এডভোকেট সঞ্জিত কুমার বিশ্বাস এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে সেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত দুই স্বতন্ত্র প্রার্থি রফিকুল ইসলাম এবং এড. হাফিজুর রহমান বাবলু মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। কোন কারণে আওয়ামীলীগের ভোট ভাগ না হলে সঞ্জিত কুমার এ বছরও বিজয়ী হবেন বলে আশা করছেন তার শুভাকাংখিরা। তবে বিএনপি প্রার্থী ও সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সচেষ্ট রয়েছেন আওয়ামীলীগের একটি অংশের ভোট নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের ফল অন্যরকম হয়েও যেতে পারে। ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদর উপজেলার গোপালগ্রাম ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রাজিব হোসেন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এবারও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন। অন্যদিকে গতবারের পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী নাসিরুল ইসলাম মিলন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। এ ইউনিয়নে বিএনপির সজিব বিশ্বাস স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইতোমধ্যেই তিনি শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে ভোটারদের মধ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন। এছাড়া এ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিনের ছেলে আল ইমরানও জাসদের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। মঘি ইউনিয়নেও যথারীতি নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছেন স্বামী আব্দুল হাই এর মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের হাসনা হেনা। তার প্রতিদ্বন্দী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান রনজু। অন্যদিকে কছুন্দি ইউনিয়নেও আওয়ামীলীগের নেতা মো. কাশেম মোল্যাও শক্ত প্রতিদ্বন্দীতায় পড়েছেন মাগুরা জেলা যুবলীগ সদস্য সাবেক চেয়ারম্যান বাকি বিল্লাহ সান্টুর বিদ্রোহে। অপেক্ষাকৃত অনেক তরুন প্রার্থী সান্টু সম্প্রতি করোনার মহামারি চলাকালে করোনায় মৃতের কবর খোঁড়া, করোনা রোগীর জন্য অক্সিজেন, খাবার পৌছে দেয়াসহ যুবলীগের হটলাইন টিমের একজন ফ্রন্টলাইনার হিসেবে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। ফলে তিনি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন বলে জানান স্থানীয়রা। এ অবস্থায় জেলার সদর উপজেলার ১৩ইউনিয়নে গত নির্বাচনের তুলনায় শক্ত প্রতিদ্বন্দীতা হতে চলেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ঠরা। এতেকরে কোন কোন ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা গেছে খোদ সরকারি দলের নেতাদের মধ্যেও। তবে এবারের নির্বাচন কোন প্রকার প্রভাবমুক্ত থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে প্রশাসন বদ্ধ পরিকর বলে একাধিক সরকারি কর্মসূচীতে উল্লেখ করেছেন মাগুরার জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম। নির্বাচন সুষ্ঠ করতে তিনি প্রয়োজনে আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

রূপক/ মাগুরা /০৮ নভেম্বর ২০২১