মহম্মদপুর প্রতিনিধি, মাগুরাবার্তা
নিঃসন্তান বিধবা আয়শা খাতুনের (৬৫)স্বামী মারা গেছেন প্রায় ১০ বছর আগে। বাবা-শশুরবাড়ির কূলের প্রায় সবাই মারা গেছেন। স্বামীর ভিটেয় একটি ভাঙা-চোরা জরাজীর্ণ ঘরে একা বাস করেন। সরকারি একটি ঘর পাননি, ভাগ্যে মেলেনি কোনো ভাতা বা সাহায্য।

শেষসম্বল স্বামীর বসত ভিটার জমিটুকু কেড়ে নিতে প্রতিবেশীরা মরিয়া।একঘোরে করে দিয়ে তাঁর সাথে কেউ কথা বলেন না এমনকি সম্পর্ক রাখেন না আশপাসের কতিপয় লোকজন। উচ্ছেদ করতে মারধোর থেকে শুরু করে ঘরে আগুন দেওয়াসহ চালাচ্ছেন নানা রকম অত্যচার-নির্যাতন।বিচারের আসায় সমাজ পতিদের দ্বারে-দ্বারে ঘুরলেও তাঁর সাথে নেই কেউ।

অসহায় এই নারী বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার দীঘা ইউনিয়নের জনার্দ্দনপুর গ্রামে। মহম্মদপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে নিভৃত গ্রাম জনার্দ্দনপুরে পৌছে আয়শার বাড়ি খুজেঁ পেতে কষ্ট হয় না। আয়শা খাতুনকে সবাই চেনেন। ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে নির্বাক বসে ছিলেন বৃদ্ধা আয়শা খাতুন।
ঘর বলতে মাটির ডোয়া। জরাজীর্ণ পাঠকাঠির বেড়া। ঘর জুড়ে ইঁদুরের বসতি। জীর্ণ বেড়া খসে খসে পড়ছে।ভেঙে যাচ্ছে মাটির ডোয়া। গত বছর ঝড়ে টিনের চালটি উড়ে গেছে। কোনমতো চালটা আবার বসিয়ে রেখেছেন। বাতাস আসলে যেকোনো সময় আবার পড়ে যেতে পারে। ঘরের মেঝেতে চট বিছিয়ে ঘোমান।
জানতে চাইলাম তাঁর সম্পর্কে। আয়শা খাতুনের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বাকরুদ্ধ তিনি। কিছুক্ষণ পর বলতে শুরু করলেন তার জীবন-সংগ্রাম আর অসহায়ত্বের গল্প।
স্বাধীনতার পর ১২ বছর বয়সে আয়শার বিয়ে হয়। তাঁর বাবার বাড়ি মহম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়া ইউনিয়নের ছোট কলমধারী গ্রামে। অভাব আর দারিদ্রতা নিয়েই তাঁর জন্ম। বিয়ে হয় স্বামী ওয়াজেদ শেখের সাথে। ওয়াজেদ ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক। স্বামীর চোদ্দ শতক জমির উপর বসত ভিটায় তিনি একা বাস করেন।
এই এক খন্ড জমিই এখন তাঁর বিপদের কারণ।নিঃসন্তান এই বৃদ্ধার জমিটুকুর উপর প্রতিবেশিসহ অনেকের লোলুপ দৃষ্টি। দশ বছর আগে স্বামী মারা যান।
স্বামীর মৃত্যুর পর আরও অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। বাবা-শুশুর বাড়িরকূলে তাকেঁ দেখার আর নেই।
প্রতিবেশী কয়েকজন তাঁকে একঘরে করেছেন বলে তিনি জানান। তাঁর সাথে কেউ কথা পর্যন্ত বলেন না। কয়েক দিন আগে গভীর রাতে তাঁর ঘরের বেড়ায় কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়। টের পেয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলায় এযাত্রায় বেঁচে যান তিনি। ঘরের বেড়ায় আগুনের পোড়া চিহ্ন এখনো স্পষ্ট।গভীর রাতে ঘরে ঢুকে তাকে বাড়ি ছাড়ার জন্য ভয় দেখান বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আয়শা খতুন জানান, আমার কেউ না থাকায় সবাই আমার জমিটুকু দখল করতে চান। তিনি স্বামীর ভিটায় মরতে চান। কোথাও যেতে চান না। এমনকি জমি বিক্রি করতে চান না।জমি দিতে না চাওয়ায় প্রতিবেশী কয়েকজন তাকে উচ্ছেদ করার জন্য নানা হয়রানি ও অত্যাচার করছেন। কয়েক বছর আগে থানায় অভিযোগ করেও তিনি প্রতিকার পাননি।অসহায়-দরিদ্র হওয়ায় সমাজপতিরা তাঁর সাথে কেউ নেই বলে তিনি জানান। অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।
আয়শা খাতুন বলেন, শুনছি সরকার ঘর বানায় দিচ্ছে। আমার বাড়ির আশপাশে বড়লোকেরা ঘর পাইছে আমারে কেউ দেয় না। চেয়ারম্যান-মেম্বরগের পাছে বছরের পর বছর দোড়োইছি কোন লাভ হই নেই। বয়স্ক-বিধবা বা দশ টাহার চালির কার্ড কোনডাই আমার কপালে জুটি নেই।Magura Aysa 03
গত বছর ঝড়ে ভাঙ্গে পড়া ঘর আর সারতি পারি নেই।আমার এটটা সরকারি ঘর খুবই দরকার।সারব যে আমার কোন টাহা-পয়শা নাই। ঘরডা পড়ে গিলি ভিটেততে আমারে উচ্ছেদ করে দিবেনে। আপনারা সরকাররে এটটু কবেন –আমারে যেন এটটা ঘর বানায় দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রউফ মিয়া জানান, নিঃসন্তান বিধবা আয়শা নিদারুণ কষ্টে আছেন। তাঁর স্বামীর বসত ভিটার উপর অনেকের লোভ। অসহায় এ্ নারীকে দেখার দেখার কেউ নেই।নিদারুন কষ্টে আছেন তিনি। তাঁর একটা সরকারি ঘর খুবই দরকার।Magura Aysa 01
আয়শার বাড়ি জর্নাদ্দনপুর এলাকার দীঘা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও বর্তমানে প্যানেল চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা খোকন মিয়া জানান, আয়শা খাতুনের বিষয়টি তিনি জানেন। অল্পদিন হলো চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন।অসহায় ও্ নারীর নিরাপত্তা ও সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার জন্য তিনি তৎপর হবেন বলে জানান।
মহম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তারক বিশ্বাস বলেন, বিষয়টি আমি খোঁজনিয়েঁ দেখব। তাঁর সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয়ও পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান তিনি।
কথা শেষ করে আয়শা খাতুনের বাড়ি থেকে পা বাড়ালাম। আবার ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে শূন্যে দৃষ্টি তাঁর। নির্বাক অবয়বে অসংখ্য জিজ্ঞাষা- শেষ জীবনে তাকেঁ কে দেখবে ? কোথায় যাবেন ? কার কাছে যাবেন তিনি- ‘নিঃসন্তান বিধবা বৃদ্ধা আয়শার জন্য সত্যিই কি কেউ নেই?’

শাহীন/ মহম্মদপুর/ মাগুরা / ৪ মার্চ ২০২১