বিশেষ প্রতিনিধি, মাগুরাবার্তা
মাগুরার শালিখা উপজেলার কুশখালি গ্রামে মুন্তাজ উদ্দিন হত্যা মামলায় স্বাক্ষী দেয়ার কারণে এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারসহ স্বাক্ষী ও বাদীর উপর অমানবিক অত্যাচার করছে প্রতিপক্ষরা। একের পর এক হামলা ভাংচুরে পরিবারগুলির সদস্যরা আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। হামলার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে মামলার প্রধান স্বাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা পুত্র সাখাওয়াত হোসেন। মামলার বাদি মতিয়ার রহমান মোল্যাও হামলার ভয়ে গ্রামে আসতে পারছেন না। অনাবাদি হয়ে আছে বিঘার পর বিঘা জমি। বাদি ও স্বাক্ষীদের উপর ৮ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এমন চলছে অত্যাচারে স্থানীয় পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরেজমিন কুশখালি গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২২ অক্টোবর সকালে ওই গ্রামের মোন্তাজ উদ্দিন (৩৫) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ একই গ্রামের গোলাম সরোয়ার ও তার লোকজন। এ ঘটনায় মোস্তাজের বাবা মতিয়ার রহমান বাদি হয়ে ৪১জনের নামে মামলা দয়ের করেন। সম্প্রতি ওই মামলার বিচারের জন্য স্বাক্ষী গ্রহণ শুরু হয়। স্বাক্ষী গ্রহণের এক পর্যায়ে গত ৫ই নভেম্বর মামলার প্রধান স্বাক্ষী ওই গ্রামের প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা বাবর আলী বিশ্বাসের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন মাগুরা জেলা জজ আদালতে আসামীদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী প্রদান করেন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে আসামীরা জেলা জজ আদালতের মধ্যেই সাখাওয়াতকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এরই জের ধরে ৮ নভেম্বর রাতে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে সাখাওয়াত হোসেনে বাড়িতে আক্রমন করে তার বাড়ির গেট ভেঙ্গে বাড়িতে প্রবেশ করে। পরে তারা একে একে ওই বাড়ির মূল ঘরের জানালা, দরজা, গ্রীল, গেটসহ বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর চালায়। তারা বাড়ির সদস্যদের গহনা, নগদ টাকা ও পানির মটরসহ বিভিন্ন জিনিস লুটপাট করে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা সাখাওয়াতের বাড়ির রান্নাঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে মামলার অপর স্বাক্ষী শরীফুল ইসলাম ও তার ছেলে হুমায়ুনকে কুপিয়ে জখম করে সরোয়ার মিয়ার লোকজন। তারা এক মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছেন। কিছুদিন আগে হামলা চালিয়ে মামলার প্রধান স্বাক্ষী সাখাওয়াতের স্ত্রী আসমা বেগমকে পিটিয়ে পায়ের হাটু ভেঙ্গে দেয় দুর্বৃত্তরা। বর্তমানে তিনি পঙ্গু অবস্থায় বাড়িতে দিনপাত করছেন। অভিযোগে জানা যায়, গ্রাম্য মাতব্বর সরোয়ারের নেতৃত্বে ওই গ্রামের ওলিয়ার, শাকিল, রাসেল, ওহিদার, কায়েম আলী, আতিয়ার, আল আমিন, মশিয়ার, মোসলেম হোসেন, মিলন, মেহেদী হাসান, কামাল হোসেন, বাহারুলসহ অর্ধ শতাধিক মানুষ অংশ নেন।
মামলার বাদি মতিয়ার রহমান জানান- নিজের ছেলেকে হারিয়ে এমনিতে আমি প্রচন্ড মানসিক কষ্টের মধ্যে আছি। তার উপরে আসামীরা সংঘবদ্ধ হয়ে আমাদের স্বাক্ষী না দিতে ও মামলা তুলে নিতে প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে। তাদের অত্যাচার থেকে বাচতে আমি এখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। তাদের অত্যাচারে গত কয়েক বছর ধরে আমি নিজের জমিতে চাষ করতে পারছি না। চাষের জন্য মাঠে শ্রমিক পাঠালে তারা আমাদের শ্রমিকদের মারপিট করে উঠিয়ে দেয়।
মামলার প্রধান স্বাক্ষী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা এলাকায় শিক্ষিত ও সম্মানিত পরিবার হিসেবে সুনামের সঙ্গে বসবাস করি। মারামারি বা দলাদলির কোন কিছুর সঙ্গে আমরা জড়াতে চাই না। এলাকায় ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর মোন্তাজ হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বাক্ষী হওয়ায় আমার পরিবারের উপর অমানসিক অত্যাচার শুরু করে এ এলাকার সাখাওয়াত হোসেন ও তার দলের লাঠিয়াল প্রকৃতির লোকজন। এদের অত্যাচারের কারণে আমি এবং মামলার বাদি এখন বাড়িতে যেতে পারছি না। আত্মিয় স্বজনের বাড়িতে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছি।
সরেজমিনে কুশখালি গ্রামে সাখাওয়াত হোসেনের বাড়িতে গেলে দেখা যায় সেখানে বাড়ির প্রতিটি মানুষের মুখে আতংকের ছাপ। বাড়ির প্রধান গেট থেকে শুরু করে প্রতিটি স্থানে ভাংচুর আর অগ্নিকান্ডের চিহ্ন। দুর্বৃত্তরা বাড়ির স্টীলের গেটসহ সব জায়গায় ধারালো অস্ত্রদিয়ে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। সাখাওয়াত হোসেনের স্ত্রী আসমা বেগম জানান- নারী ও শিশু ছাড়া বাড়িতে কোন পুরুষমানুষ থাকতে পারছে না। প্রতিপক্ষরা রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টহল দিচ্ছে। শিশুরা আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। পুলিশে খবর দিলেও তারা কোন ভ‚মিকা নিচ্ছে না। এমনকি তাদের বাড়িঘর ভাংচুর অগ্নিসংযোগ হলেও কেউ দেখতেও আসেনি।
এ প্রসঙ্গে অভিযুক্ত সরোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের জানান- সাখাওয়াত হোসেনের বাড়ির ছাদ থেকে তাদের বাড়ির দিকে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করলে বিক্ষুব্ধ লোকজন তাদের বাড়িতে আক্রমন চালায়। সাখাওয়াতের পরিবারের উপর অত্যাচারের কথা তিনি অস্বীকার করেন।
এ প্রসঙ্গে মাগুরার পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ রেজওয়ান জানান- ঘটনা জানার সাথে সাথে তিনি শালিখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে মামলা গ্রহণ করে দ্রæত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে শালিখা থানায় দ্রæত বিচার আইনে একটি মামলা হয়েছে। কায়েম আলী নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আশাকরি অন্য আসামীরাও গ্রেফতার হবে।
রূপক আইচ/মাগুরা /১০ নভেম্বর ২০২০