অনুপমা হক, মাগুরাবার্তা
আজ আমার বাবার মৃত্যুর এক বছর হয়ে গেল। মনে হচ্ছে চোখের পলকে বাবাকে ছাড়া দিনগুলি চলে গেল । আব্বা যেমন আমাদের বাবা হিসেবে একজন সফল বাবা ছিলেন। একইভাবে শিক্ষক ও সমাজকর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন মাগুরার আপামর মানুষের প্রাণের মানুষ। চায়ের আড্ডা কিংবা দাবার আসরে তিনি শিক্ষকের আসনের উপরে উঠে মানুষের প্রাণের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।

দাদা ওপারে চলে গিয়েছিলেন সেই ১৯৯২ সালের মার্চের ১১ তারিখে। এরপর বেশখানিকটা সময় দাদী রইলেন আমাদের মাঝে, দাদীও চলে গেলেন ২০০৪ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী। তখন থেকেই আমার মনে হতে শুরু হয়েছিল আব্বাও কি চলে যাবেন? হ্যাঁ যাবেন, জানতাম কিন্তু মানতে ভয় পেতাম, কিন্তু মনে মনে হিসেব করতাম দাদা বেঁচে ছিলেন ৯৩ বছর বয়স পর্যন্ত। দাদী ৮৭ । আব্বা নিশ্চয় থাকবেন দাদার মত অন্তত ৯৩ বছর বয়স পর্যন্ত ।  বয়স মনে আসেনি কখনো।  এসবই আপনেজনকে ধরে রাখার মনের আকুতি। কিন্তু আব্বা দাদীর বয়স পর্যন্তও রইলেন না, চলে গেলেন ৮০ বছর বয়সেই। সবাই-ই বলে বয়স হয়েছিল চলে যাবেন এটাই স্বাভাবিক কিন্তু বয়স হলেও আপনজনের চলে যাওয়া আপনজনের কাছে সবসময়ই অকালমৃত্যুই ।  আমার আব্বা ছিলেন ভীষণ মেধাবী শিক্ষার্থী,  ম্যাট্রিক পর্যন্ত কখনো ক্লাসে দ্বিতীয় হননি, ম্যাট্রিকে যশোর বোর্ডে সকল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটেও রাজশাহী  বোর্ডের মধ্যে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অর্জন করেছিলেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। সে পর্যায়ে আর অত ভাল ফলাফল ধরে রাখতে পারেননি কারণ তিনি ততদিনে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। রাজনীতি করবেন বলে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মানবিক বিভাগে চলে এলেন। দাদা তাঁর মেধাবী ছেলের কাছে যা আশা করেছিলেন সেখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল রাজনীতি। তবে দাদা চাকরী থেকে অবসর পেয়ে গেলে  আব্বাই যৌথ পরিবারের হাল ধরেছিলেন বড় ছেলের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছিলেন। ভীষণ মনোবল আর সংগ্রামী মানুষ হওয়াতে সবই দ্বায়িত্বই সঠিক ভাবে পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন আজীবন। এরপর দেশ রক্ষার সংগ্রামের সাথেও জড়িয়ে গেলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে বাড়ি ছেড়েছিলেন। শুনেছি রাতের আঁধারে আব্বা আসতেন পরিবারের সবাইকে দেখতে কিন্তু একবার ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক অত্যাচারিত হয়েছিলেন বিহারীদের হাতে কিন্তু আবার পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। আব্বা কে খুঁজে পায়নি বর্বর হানাদার বাহিনীরা কিন্তু আমার ফুপু লুৎফুন্নাহার হেলেনকে ধরিয়ে দিল রাজাকার বাহিনীর রিজু পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে। আর ফেরেননি ফুপু পরিবারের কাছে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল ফুপুকে। দেশ স্বাধীন হয়েছিল, আমাদের বাবা ফিরেছিলেন কিন্তু ওপারে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বোন হারানোর চরম দুঃখ কষ্ট নিয়ে বেঁচে ছিলেন আমাদের মাঝে আমাদের নিয়ে। আমরা পাঁচ ভাইবোন আমাদেরকেও মানুষের মত মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। সমাজের আর দশটা মানুষের মত মানুষ আমার আব্বা ছিলেন না। তাইতো নিজের স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পদ সমপরিমাণে বন্টন করে গিয়েছেন ছেলেমেয়ে আর স্রীর মধ্যে। আজীবন মনে মনে যা মেনেছেন তাই-ই বাস্তবেই পালন করার চেষ্টা করেছেন।   আমার ফুপু চলে গিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ৫ই অক্টোবর আর আমার আব্বা চলে গেলেন ২০১৯ সালের ৫ই অক্টোবর। আমার আব্বার চলে যাওয়ার পর মাগুরাবাসী নাগরিক বিদায় সংবর্ধনা আয়োজন করেছিলেন এবং আব্বা কে “মাগুরার বাতিঘর” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মাগুরাবাসীর কাছে আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ রইলাম আমার বাবাকে তাঁর সঠিক সম্মান দেয়ার জন্য। এ ভারী কঠিন কষ্ট সকলেই বলে এটাই ধরণীর নিয়ম মেনে নিতে হয়। হয়ত সময়ের সাথেসাথে মেনেও নিই আমরা কিন্তু মন কে কি মানিয়ে নিতে পারি।

জন্মিলে মরিতে হয়
অমর কে কোথা কবে।