শম্পা বসু, মাগুরাবার্তা
করোনা সংক্রমণের ভয়ে এবং সুরক্ষার প্রয়োজনে সবাইকে ঘরে থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করা হয়েছিল। জীবন বাঁচাবার জন্য জীবনের গতিকে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে সময় আমরা ভেবেছিলাম, নিম্নআয়ের মানুষের কাজ না থাকলে সংসার চলবে কিভাবে ? সবার সহযোগিতা নিয়ে কর্মহীন মানুষের বাড়িতে সামান্য কিছু খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করেছিলাম বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ মাগুরা জেলা শাখার উদ্যোগে। আমরা দেখেছিলাম দরিদ্র মানুষেরা খাদ্য সহায়তা যেমন চান তেমনি চান তাদের সন্তানদের শিক্ষাটাও যেন চালু থাকে। অভাবের তাড়নায় পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাবে কি ? এই উদ্বেগ ছিল তাদের চোখেমুখে। আমরা তখন ভাবলাম, খাদ্য সহায়তা হয়তো অনেকেই করবে কিন্তু এই সব শিশু কিশোরদের শিক্ষাজীবন রক্ষা করা যাবে কিভাবে? সেই ভাবনা থেকেই আমাদের সীমিত সামর্থ্য দিয়েই শুরু হলো ‘অদম্য পাঠশালা—করোনায় থামবেনা পড়া’র কার্যক্রম।

অদম্য পাঠশালার ১০০ দিন:

পশ্চিম দোয়ারপাড়, সর্দারপাড়া। মাটির ঘর, উপরে টিন। একটি ঘরে একটি পরিবার, বাবা-মা,ভাই-বোন, দাদা-দাদী। বারান্দায় খাট পাতা, বয়স্করা ঘুমায়। ঘুমানো ছাড়া কেউ ঘরে থাকে না। বাইরে খোলা জায়গায় কাজ করে, সময় কাটায়।পড়ার টেবিল-চেয়ার নেই অধিকাংশ ঘরে। একজনের কিনে রাখা পড়ে থাকা জায়গায় টিনের চাল দিয়ে রান্নাঘর। পাঁচ-ছয়টি উঠানে মেশানো মাটির চুলা। সেখানেই পালাক্রমে সবার রান্না চলে। চারিদিকে অভাবের ছাপ। করোনার সময় তা আরও বেড়ে গেছে। বিধবা বাসন্তী বিশ্বাস তার একমাত্র স্বর্ণের দুল বেচে দিয়েছেন করোনা দুর্যোগে। প্রত্যেক পরিবারই চলেছে এভাবে। ধার করে অথবা পরিবারের অল্প যা কিছু সম্পত্তি তা বিক্রি করে। অত অভাবের মাঝেও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কি স্বপ্নময় চোখ! কত অল্পতেই ওরা খুশি হয়ে যায়! অনলাইন ক্লাস করার জন্য ল্যাপটপ,এনড্রয়েড ফোন এসব ডিভাইস তো দূরের কথা অধিকাংশের বাড়িতে টেলিভিশনই নেই। যেখানে পরিবারে খাবার জোটানোই কষ্ট সেখানে গৃহশিক্ষক রেখে ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াবেন কিভাবে বাবা-মা? এমন স্কুল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা সহযোগিতা করার জন্যই অদম্য পাঠশালা।

গত ২৮ মে ২০২০ বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর উদ্যোগে এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সহযোগিতায় মাগুরা শহরে ‘অদম্য পাঠশালা’র যাত্রা শুরু। যেসব স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীর অনলাইনে ক্লাস করার ডিভাইস নেই, গৃহশিক্ষক রেখে প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য নেই বা তাদের অভিভাবকদেরও শিক্ষাগত অবস্থান এমন নয় যে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনায় নিজেরাই সহযোগিতা করবেন; সেই সব শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ঝরে না পরে সেই লক্ষ্যে অদম্য পাঠশালা বিনা বেতনে স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষা সহায়তা ক্লাস চালু করে। মাগুরা শহরে দু’টি ইউনিটে অদম্য পাঠশালা পরিচালিত হয়। শুরুতে ৬০জন শিক্ষার্থী নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি। দিনে দিনে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়ে হয়েছে একশত জন। মাগুরা জেলায় অদম্য পাঠশালার কার্যক্রমে উৎসাহিত হয়ে এখন সারাদেশে ২২টি জেলায় ৩৭টি ইউনিটে সেটা পরিচালিত হচ্ছে ।

দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র !

কেবল করোনা দুর্যোগের সময়ই নয়; লেখাপড়া এতো বেশি অর্থ(টাকা) নির্ভর হয়ে পড়েছে যে দরিদ্র মানুষের সন্তানরা সবসময়-ই শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কায় থাকে।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়া হয় ৩০% আর ছাত্রদের ১০%। অর্থাৎ একটি স্কুলে ১০০ জন ছাত্রী থাকলে উপবৃত্তি পাবে ৩০ জন। মাগুরা শহরে গরীব পরিবারের ছেলেমেয়েরা কোন কোন স্কুলে ভর্তি হতে পারবে তা প্রায় সুনির্দিষ্ট । ফলে এসব স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী উপবৃত্তির প্রত্যাশা করে। স্বাভাবিকভাবেই স্কুল কর্তৃপক্ষকে ছাঁটাই প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। উপবৃত্তি পাওয়ার শর্ত ১| নিয়মিত স্কুলে আসতে হবে ২| প্রত্যেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে ৩| অবিবাহিত হতে হবে ।

অতি দরিদ্র পরিবার স্কুলের সামান্য ফিও সময় মতো জোগাড় করতে পারে না । স্কুলে ফি জমা না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থী স্কুলে যেতে চায় না (অপমানিত হতে হয়)। এসব পরিবারের অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা গৃহকর্মীর কাজ করেন । ফলে বাড়ির সকল গৃহস্থালি কাজ মেয়েকে করতে হয়। দারিদ্র্যতার কারণে কোচিং বা প্রাইভেট শিক্ষকদের কাছে পড়াশোনা করার সুযোগ তাদের হয় না । পরীক্ষায় ফলাফল ভালো হয় না । ফলে উপবৃত্তির টাকা পাওয়া যায় না । স্কুলে পড়াশোনা করানো বাবা-মার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে । অতঃপর বাল্য বিবাহেই নিষ্কৃতি মেলে!!!

গত বছর অষ্টম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষার সময় জবার বাবা মারা যান । অভাব আরও জেঁকে বসে। পরীক্ষায় ফেল করে জবা। অতঃপর পড়াশোনা বন্ধ । অদম্য পাঠশালা তাকে আবারও পড়াশোনায় ফিরিয়ে এনেছে ।

শতফুল ফুটতে দাও :

দোয়ারপাড় ইউনিটে ‘অদম্য পাঠশালা’ চালুর কিছুদিন পর একজন স্বচ্ছল পরিবারের ছাত্রী তনুশ্রী পড়তে আসলো। শহরের সবচেয়ে ভালো ছাত্রীদের স্কুলে সে পড়ে। তার পোষাক-পরিচ্ছেদ সবকিছুতেই আভিজাত্যের ছাপ। আরও কিছুদিন অতিবাহিত হলে তনুশ্রী একদম মিশে গেল সবার সাথে; পরিবারের আর্থিক অবস্থার পার্থক্য অন্যদের সাথে তার মনের পার্থক্য তৈরি করতে পারেনি। একসাথে পড়াশুনা, পাঠশালা শেষে খেলাধুলা, গল্প-আড্ডা, ওদের ছেড়া বিছানায় শুয়ে পরা— ও যেন ওদেরই একজন! এমনই তো হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যেন কেবল বৈষম্যটাকেই আরও প্রকট করে তোলে। এই করোনার সময়েও অনলাইনে ক্লাস-প্রাইভেট-ব্যাচ সবই চলছে। কিন্তু দেশের ৮০ভাগ স্কুল শিক্ষার্থীরই তো সামর্থ্য নেই অনলাইন ক্লাস করার, তাদের কথা কি সরকার ভেবেছে? যাদের খাদ্যেরই অনিশ্চয়তা আছে, যেসব ছাত্র-ছাত্রীকে বাবা-মায়ের সাথে কাজে বেরোতে হয়, যখন স্কুল ছিল তখন খালিপেটে স্কুলে যেতে হয়—কিভাবে তারা পড়াশুনা করবে? এদের কথা না ভেবে, এদেরকে বাদ দিয়ে কি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভাবা যাবে? দেশের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা যাবে? এর উত্তর অবশ্যই ‘না’ হবে।

এ দেশকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমরা :

এ দেশকে যদি বাসযোগ্য করতে হয় কি করতে হবে? কেউ বলবেন দুর্নীতি ঠেকাতে হবে, কেউ বলবেন পরিবেশ বাঁচাতে হবে, কেউ বলবেন সবার ভেতর দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। এই প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথেই শিক্ষা যুক্ত। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অর্থের খেলা, দুর্নীতি। দেশে যদি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার (পিইসি) প্রশ্নও ফাঁস হয় তবে নৈতিকতা কিভাবে গড়ে উঠবে? প্রত্যেক মূহুর্তে জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে দেশটা এমপি-মন্ত্রী, আমলা আর লুটপাটকারীদের!! দেশপ্রেম কিভাবে তৈরি হবে? কথা শেখার আগেই শিশুদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে বাবা-মার অর্থ সম্পদের পরিমাণের উপর নির্ভর করছে তার জীবন, অধিকার ও নিরাপত্তা। এই অবস্থার পরিবর্তন আমরা চাই। এই শিশুদের জীবন-বিকাশের সমস্ত আয়োজন রাষ্ট্র করবে– সেজন্য প্রয়োজন ব্যবস্থার পরিবর্তন।

রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক অধিকার চাওয়ার সাথে সাথে নিজেদের সীমিত সামর্থ্যে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজটাও করতে হবে বলে আমরা মনে করি। এ দেশ আমাদের, একে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। কখনো পথটাকে দুর্গম মনে হয়, কিন্তু ইতিহাস বলে পথে নামলে পথের সাথী পাওয়া যায়। দুর্গম পথে শত শত সাথীদের মিলিত সংগ্রামে আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চাই। সবার সহায়তায় আমরা বিজয়ী হবোই। আমরা করবো জয় একদিন ।

লেখক: প্রকৌশলী শম্পা বসু, সমন্বয়ক, অদম্য পাঠশালা, মাগুরা জেলা