বিশেষ প্রতিনিধি,মাগুরাবার্তা
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বাবুখালি ইউনিয়নের কেড়িনগর গ্রামে আঁখি খাতুন (২০) নামের এক কলেজ ছাত্রীকে তার সাবেক স্বামী ও স্বামীর স্বজনদের বিরুদ্ধে হাত-পা বেঁধে গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় আজ ১৭ আগস্ট সোমবার বিকেলে মামলা হয়েছে। পুলিশ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে।
অগ্নিদগ্ধ আঁখি খাতুনকে মুমূর্ষূ অবস্থায় প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতাল, ফরিদপুর হাসপাতাল পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। গত ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় বসত ঘর থেকে ১০গজ দূরে সৌচাগারের সামনে থেকে আঁখিকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে তার বাড়ির লোকজন।এ ঘটনার পর থেকে অভিযুক্তরা পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আঁখি খাতুনের সাবেক স্বামী নাজমুল মোল্যার দাদি ও চাচি ঘটনাটি আত্মহত্যার চেষ্টা বলে দাবি করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, মহম্মদপুর উপজেলার বাবুখালি ইউনিয়নের কেড়িনগর গ্রামের আকরাম মোল্যার মেয়ে আঁখি খাতুন ও প্রতিবেশি মাসুদ রানা মোল্যার ছেলে নাজমুল স্থানীয় একই স্কুলে পড়ার সময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এসএসসি পরীক্ষায় আঁখি উত্তীর্ণ হলেও নাজমুল অকৃতকার্য হয়। নাজমুল লেখাপড়া বাদ দিলেও আঁখি মহম্মদপুর সদরের কাজী সালিমা হক মহিলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক মানবিক ভর্তি হয়। নাজমুল বেকার যুবক। সম্প্রতি গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল বলে জানা যায়। দুই বছর আগে তারা পরিবারকে না জানিয়ে নিজেরা বিয়ে করে। ছয়মাস সংসার করার পর আঁখি নাজমুলের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
সম্প্রতি উভয়ের মধ্যে আবার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। নাজমুল আঁখিকে বিয়ে করার জন্য তার পরিবারকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে।ছেলের মামা একই গ্রামের অধিবাসী বাবুল মোল্যা ও মুকুল মোল্যা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মেয়ের বাবার বাড়িতে একাধিকবার আসলেও তা প্রত্যাখ্যান করেন। ঘটনার দুইদিন আগে নাজমুলের বাড়িতে উভয়পক্ষের গ্রাম্য মাতুব্বর দবির মোল্যা ও রফিক কাজীর নেতৃত্বে বৈঠক বসে। বৈঠকে আঁখির পরিবারকে বিয়ে দেওয়ার জন্য বলা হয়। আঁখির বাবা আকরাম মোল্যা বিয়ে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অগ্নিদগ্ধ হওয়ার আগের রাতে সাবেক স্বামী নাজমুল তার নিকটাত্মীয় ও বন্ধুসহ ৫/৬ জন আঁখির বাড়িতে বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।
আখিঁর চাচি শারমিন, নাসরিন, কাকা আনিচুর রহমান, চাচাতো ভাই নাসির মোল্যা জানান, বিয়ের প্রস্তাবে ব্যর্থ হয়ে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বিয়ে না দিলে আত্মহত্যা করবে এবং দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়ে চলে যায় বলে তারা জানায়।
আঁখির দাদা রতন মোল্যা (৭০) জানান, ১৫ আগস্ট সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে আঁখির ঘরের আনুমানিক ১০ গজ দূরে সৌচাগারের সামনে আগুন ও চিৎকার শুনে এগিয়ে যান। তিনি তখন ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন। গিয়ে দেখেন নাতী আঁখির গায়ে আগুন জলছে। জ্বালানি তেলের বিকট গন্ধ বের হচ্ছে। নিজের ওড়না দিয়ে সৌচাগারের বাঁশের খুটির সাথে আঁখির হাত পা বাধা দেখতে পান বলে জানান।
প্রতিবেশি আরও ৪/৫ জনের সহায়তায় পানি ঢেলে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে আঁখিকে উদ্ধার করে ঘরের বারান্দায় নিয়ে আসেন।গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় প্রথমে তাকে মাগুরা সদর হাসপাতাল তারপর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়।
ঢামেকের বার্ণ ইউনিটে সাথে থাকা আঁখির মা নারগিস বেগম ফোনে বলেন, তার মেয়েকে (আঁখি) আবার বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়ে সাবেক স্বামী নাজমুল ও তার স্বজনেরা হাত-পা বেধে গায়ে কেরাসিন দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে। হাসপাতালে তার মেয়ে এ ঘটনায় জড়িতদের নাম উল্লেখ করে জবানবন্দি দিয়েছে বলে জানান। আঁখির শরীরের ৯০ ভাগ আগুনে পুড়ে গেছে। তার অবস্থা এখন সংকটাপন্ন বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন বলে তিনি জানান।
নিভৃত গ্রাম কেড়িনগর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার কাদার রাস্তা পার হয়ে আঁখি ও নাজমুলদের বাড়ি। উভয়ের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ২০০ গজ। দরিদ্র পরিবারে পাটকাটির বেড়া আর ঝুপড়ি টিনের চালের ঘরে তাদের বসবাস। আঁখির বাবা ঢাকায় গাড়ি চালান। নাজমুলদের বাবা প্রান্তিক কৃষক। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে আঁখি বড়। তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজমুল সবার বড়।
নাজমুলের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, ঘর তালাবদ্ধ বাড়িতে বাবা-মা কেউ নেই। দাদি ফিরোজা বেগম (৭০), চাচী রতœা জানান, নাজমুল আবার বিয়ে করতে চাইত কিন্তু আখিঁর বাবা রাজি ছিল না। ঘটনার দিন বিকেলে আঁখিকে মারধোর করে তার বাবা।পরে তাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হবে বলে ছেলে দেখতে যায় তারা।বিষয়টি আসপাশের সবাই জানে। পরে সে রাগে ক্ষোভে ঘরে থাকা সেচের জন্য এনে রাখা স্যালো ইঞ্জিনের জ্বালানি তেল ডিজেল গায়ে ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে গুরুতর আহত।
ঘটনার সময় নাজমুল ঘুমের ওষুধ থেয়ে বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিল্। পরে সাবেক স্ত্রী ও বর্তমান প্রেমিকা অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হওয়ার খবর পেয়ে ছুটে আখিঁর বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় সে আহত হয়।
এ ঘটনায় আঁখির দাদা রতন মোল্যা বাদি হয়ে সাবেক স্বামী নাজমুল মোল্যাকে প্রধান আসামি করে সাত জনের নামে মহম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেছেন। পুলিশ তালিকাভুক্ত ৫ জনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠিয়েেেছআটককৃতরা হলেন, কামরুল (৫০),মাসুদ (৪৫), হারেজ মোল্যা (৬২) আরিফ মোল্যা (২৬) ও বাবুল মোল্যা (৪৫)।
দাদা রতন মোল্যা জানান, আমার সামনেই আমার নাতীকে আমার সামনেই পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি আগুন নেভাতে গিয়ে আহত হয়েছি। তিনি এই ঘটনার সাথে জড়িতদের বিচার চান বলে জানান।
বাবুখালী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো: ইসমাইল হোসেন জানান, ঘটনাটি তার ওয়ার্ডে ঘটেছে। আঁখিকে আবার বিয়ে করার জন্য পরিবারকে নানাভাবে চাপ দিত তার সাবেক স্বামী নাজমুল। এ বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আঁখির বাবা তার কাছে এসেছেন বলে জানান।
মহম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তারক বিশ্বাস জানান, এ ঘটনায় মালা হয়েছে। এজাহারভুক্ত ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে।

রূপক/মাগুরা /১৭ আগস্ট ২০২০