বিশেষ প্রতিবেদন; মাগুরাবার্তা
অনেক দেশে কিংবা অঞ্চলে জন্ম হয় ইতিহাস সৃষ্টিকারী কিছু ব্যক্তিত্বের। সেখানকার ইতিহাসের সঙ্গে, সভ্যতার সঙ্গে, যাঁদের নাম একেবারে একীভূত হয়ে যায়। এইসব ঐতিহাসিক চরিত্রের অবদানে সেই জনপদ, সেই এলাকা, সেই দেশগুলো সমৃদ্ধ হয়। সেই ঐতিহাসিক পুরুষদের অবদানে ঐতিহ্যমন্ডিত হয় সমাজ ও সভ্যতা। কল্যাণ সাধিত হয় মানবতার। এমন একজন ঐতিহাসিক পূরুষ রাজা সীতারাম রায়। দক্ষিণ বঙ্গের যশোর-খুলনা অঞ্চলে তাঁর আবির্ভাব হয়।
ভারতবর্ষে মুগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাট জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। তাঁর পুত্র হুমায়ন এই সাম্রাজ্য সুসংহত ও সমৃদ্ধ করতে পারেননি। বরং সুরি সম্রাট শের শাহ সুরির হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দীর্ঘদিন বিতারিত অবস্থায় ভারতবর্ষের বাইরেও তাকে থাকতে হয়। তবে তাঁর পুত্র জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষে তাঁর রাজত্বের বিস্তার ঘটান ।
‘আকবর দ্য গ্রেট’নামে খ্যাত এই মুগল সম্রাট অনেক প্রতিকূলতার মাঝে তাঁর সাম্রাজ্য সুসংহত করেন। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান। শাহজাহানের পুত্র সম্রাট আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আরোহন করেন ১৬৫৮ সালে। শাসক হিসেবে তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে মুগল সাম্রাজ্য ক্রমান্বয়ে শিথিল হতে থাকে। আপন ভাই শাহ সুজার সঙ্গে আওরঙ্গজেবের যুদ্ধ চলাকালে বাংলার দক্ষিণাংশে আবির্ভূত হন সীতারাম রায়। তাঁর পিতা উদয়নারায়ণ রাজমহলে নবাব সরকারের চাকরি করতেন। রাজমহলে থাকার সময় বর্তমান বর্ধমান জেলার কাটোয়ার মহিপতি গ্রামের কুলীন কায়স্থের কন্যা দয়াময়ী দেবীকে তিনি বিয়ে করেন। দয়াময়ীর গর্ভে জন্ম হয় সীতারাম রায়ের। সীতারামের শৈশব কাটে মাতুয়ালয়ে। পড়ালেখাও সেখানে। চতুষ্পাঠিতে সংস্কৃত ও বাংলায়ও তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। সে সময় রাজভাষা ছিল ফারসি। তাঁর পূর্ব পুরুষদের সবাই ছিলেন মুগল রাজ কর্মচারি। রাজকার্যের কারণে শিখতে হতো ফারসি ভাষা। ফারসি ছাড়াও আরবি, উর্দু ভাষায় ছিল তাঁর বুৎপত্তি। সংস্কৃত ও বাংলায় পড়ার সময় মধ্যযুগের কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্য ও চন্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাবলী ছিল তাঁর কন্ঠস্থ। তা থেকে তিনি চমৎকার আবৃতি করতে পারতেন। তারঁ হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর । তাঁর রাজত্বকালের বিভিন্ন দলিলপত্রে তাঁর সুন্দর হাতের লেখার স্বাক্ষর দেখা যায়। তিনি দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ ও সুপুরুষ ছিলেন।
কোনো কোনো দেশে শত বছর পর এক একজন ঐতিহাসিক চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। ১৫৯৯ সালে যশোর এলাকায় রাজা প্রতাপাদিত্যের আবির্ভাব ঘটে। এর ১০০ বছর পর ১৬৯৯ খৃষ্টাব্দে স্বাধীন রাজার মতো রাজত্ব করেন রাজা সীতারাম রায়। সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬০ সালে মীর জুমলাকে বাংলার সুবাহদার হিসেবে নিয়োগ দেন। নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি এই বঙ্গের রাজধানী স্থাপন করেন ঢাকায়। তাঁর মৃত্যুর পর ১৬৬৪ সালে সুবাহদার নিযুক্ত হন শায়েস্তা খাঁ। তিনি একটানা ২৫ বছর এই দায়িত্বে থাকেন। সীতারামের পিতা উদয়নারায়ণ শায়েস্তা খাঁর আমলে রাজমহল থেকে প্রথমে ঢাকায় এবং পরবর্তীকালে রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তা বা তহশীলদার হিসেবে ভূষণায় আসেন। আগে ভূষণা ছিল বারোভুঁইয়ার অন্যতম ভূইয়া মুকুন্দরাম রায়ের রাজ্য। এরপর ভূষণা মোগলদের অধীনে এলে ভূষনায় একজন ফৌজদার নিযুক্ত হন। সে সময় ভূষণায় উদয়নারায়ণ নিজের কাছে আনেন পুত্র সীতারামকে। মধুমতি নদীর তীরে সুন্দর নগরী ছিল ভূষণা। এটি ছিল এ এলাকার রাজধানী। খুবই সমৃদ্ধ নগরী ছিল। প্রাচীন এই নগরীর এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। কিছু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন দেখা যায়। রাজকার্যের জন্য উদয়নারায়ণের ভূষণায় আবাস থাকলেও পরিবারবর্গের জন্য বর্তমানে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার গুণাবহা ইউনিয়নের হরিহরনগরে তাঁর স্থায়ী বাসভবন ছিল।
নবাব নিয়োজিত ফৌজদারের অধীনের তাঁর রাজ কর্মচারি ছিলেন উদয়নারায়ণ। ফৌজদার বৃদ্ধ ও অকর্মন্য থাকায় এলাকায় ফৌজদারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিল না। সাধারণ মানুষের কোন নিরাপত্তা ছিল না। জনসাধারণ সাধারণভাবে চলাফেরা করা, ধর্মপালন করা সহ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারতেন না। ডাকাত, মগ জলদস্যু, পর্তুগিজ দস্যুদের অত্যাচারে প্রজারা অতিষ্ঠ ছিলেন। ভূষণা বর্তমানে ফরিদপুর জেলার মধুখালি উপজেলার সদর দফতর থেকে কিছু দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। তখন কলকাতা নগরী গড়ে উঠেনি। স্থানীয় যুবকদের নিয়ে সীতারাম রায় মধুমতি নদীতে সাঁতার কাটতেন। সাঁতার, অশ্ব চালানো, তরবারি চালানো, লাঠিখেলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। সে সময় রাজকার্য পেতে হলে এইসব যোগ্যতার প্রয়োজন হতো। বর্ধমান থেকে আসা এই তরুণ ভাটির দেশের পলি মাটির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেন। অবারিত সবুজ, মায়াময় পরিবেশ, নদীর প্রবল স্রোতধারা তাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। মধুমতি নদীর উত্তাল স্রোতধারার প্রতিকুলে সাঁতার কেটে তিনি নিজের দেহসৌষ্ঠব সুগঠিত করেন। হয়ে ওঠেন শক্তিশালী। ক্রমান্বয়ে বাবার রাজকার্যে সহায়কের ভূমিকা পালন করেন।
রাজকার্যের প্রয়োজনে রাজধানী ঢাকায় যেতেন উদয়নারায়ণ। সঙ্গে নিয়ে যেতেন পুত্র সীতারামকে। সীতারাম শক্তিশালী যুবকে পরিণত হওয়ার পর তার পিতার পরামর্শে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য সুবেদার শায়েস্তা খাঁর কাছে যান। তাঁর মতো এরকম সুদর্শন, বলিষ্ঠ যুবক শায়েস্তা খাঁর নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তাঁকে সেন্যাধক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেকালে রাজকার্যের জন্য মল্লযুদ্ধ, লাঠিখেলাসহ বিভিন্ন শারীরিক কসরতে দক্ষতা অর্জন করতে হতো। যাঁরা এরকম দক্ষতা দেখাতে পারতেন, তাঁরা কাজের জন্য রাজসভায় গিয়ে হাজির হতেন। তখন মুনিরাম রায় আর রঘুরাম বা রামরূপ ঘোষ শায়েস্তা খাঁর সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মুনিরামের বাড়ি খুলনা জেলার শ্রীপুরে। রঘুরামের বাড়ি ছিল মধুমতি নদীর তীরের রায় গ্রামে। সীতারামের সঙ্গে এই দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব হয়। রঘুরাম ছিলেন দীর্ঘদেহী। প্রায় পাঁচ হাত লম্বা। গায়ে ছিল অসম্ভব শক্তি। এ কারণে তাঁকে ছোট-ঘাট একটা হাতির মতো মনে হতো। সেজন্য তাঁকে ‘মেনাহাতি’নামে ডাকা হতো। মুনিরাম ছিল সুচতুর। তীক্ষ বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। রঘুরাম ছিলেন অকৃতদার। অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ।
ভূষণার পাশেই ছিল সাতৈর পরগণা। মুগলেরা আসার আগে এ অঞ্চলে পাঠানদের শাসন ছিল। ক্ষমতা থেকে পাঠানরা চলে যাওয়ার পরও কিছু কিছু এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়ে যায়। তার মধ্যে ছিল সাতৈর। সাতৈর তখনও পাঠানমুক্ত হয়নি। সাতৈরের জায়গীরদার ছিলেন একজন পাঠান। নাম ছিল করিম খাঁ । তাঁকে কেউ পরাজিত করতে পারতো না। ভূষণার অকর্মণ্য ফৌজদার কয়েকবার সাতৈরে আক্রমন করে ব্যর্থ হন। মুগলরা সিদ্ধান্ত নেন, যে কোনো মূল্যে সাতৈরের দখন নিতে হবে। শায়েস্তা খাঁ ঘোষনা দেন, সাতৈরের জায়গীরদার করিম খাঁকে যে পরাজিত করতে পারবেন, তাঁকে ওই পরগণার দায়িত্ব দেওয়া হবে। তখন যুবক সীতারাম এগিয়ে আসেন। তিনি যুদ্ধ করতে যাওয়ার কথা জানালে শায়েস্তা খাঁ তাঁকে হাজার হাজার পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য, কামান, বন্দুক দিয়ে সেখানে পাঠান। সীতারামের সঙ্গী হন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মন্ত্রণদাতা মুনিরাম রায় আর অসীম শক্তিধর রঘুরাম ঘোষ ওরফে মেনাহাতী। যুদ্ধে করিম খাঁ পরাজিত ও নিহত হন। শায়েস্তা খাঁ সীতারামকে সাতৈর বা নলদীর পরগণার জায়গীরদার হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি চলে আসেন হরিহরনগরে। তাঁর জমিদারি সুসংহত করার জন্য কাজে নেমে পড়েন। যথারীতি পরামর্শদাতা মুনিরাম ও শক্তিমান রাঘুরামকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। আসার পথে তার সঙ্গে যোগ দেন বক্তার খাঁ, আমল বেগ নামে একজন মুগল সেনানী এবং নিম্নবর্ণের কিছু লোক। তারমধ্যে ছিলেন রূপচাঁদ ঢালী। তিনি ছিলেন নমশুদ্র। আরেকজন ছিলেন ফকিরা মাছকাটা। তিনি ছিলেন নিকারী। সে সময় শারীরিক সামর্থে শক্তিমান হলে তার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল। সীতারাম সেনাবাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলে খবর পেয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে বলশালী লোকজন যোগ দেন। খুব শীঘ্রই শক্তিশালী বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কাজে তিনি কার্পণ্য করতেন না। যেখানে সে সমস্যা ছিল, তা নিরসন করতে থাকেন। চোর-ডাকাত, পর্তুগিজ দস্যু, মগ জলদস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন। আরাকান থেকে আসা জলদস্যু ধর্মদাস মধুমতি-গড়াই নদীর সংযোগস্থল খুলুমপুরে একটা এলাকা দখল করে নিয়ে জায়গীর প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁকেও উৎখাত করেন। এসব কারণে তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় যে শাসকের এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ভালো এবং সমস্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকতো, সাধারণ প্রজারা সেখানে বসতি স্থাপন করতেন। সীতারামের রাজ্যে ছুটে আসতে থাকেন ব্যবসায়ী এবং প্রজারা। সুশাসনের এই খবর দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং মুর্শিদাবাদের নবাবের কানেও যায়। সীতারামের রাজত্বের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে। ছোটবেলায় ভূষণায় থাকাকালীন ইদিলপুর নিবাসী গরীব কায়স্থ এক সুন্দরী কন্যার সঙ্গে সীতারামের বিয়ে হয়। পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে কোনো সংস্রব ছিল না। জায়গীরদার হওয়ার পর বীরভূম জেলার দাসপলসা গ্রামের কুলীন কায়স্থ সরল খাঁ ঘোষের কন্যা কমলাকে তিনি বিয়ে করেন। তৃতীয় বিয়ে করেন বর্ধমান জেলার পাটুলি গ্রামের এক কুলীন কায়েস্থর কন্যাকে। তিন স্ত্রী থাকলেও প্রথম জনের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। ১৬৮৬ সালে পিতার পরলোকগমন করার পর সীতারাম পরামর্শদাতা মুনিরাম ও রামরূপকে সঙ্গে নিয়ে পিন্ডদানের মাধ্যমে পিতৃশ্রাদ্ধ করার জন্য গয়াধামে যান। বাবার পিন্ডদান করে সোজা চলে যান দিল্লি। সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজসভা থেকে রাজ উপাধির সনদ নিয়ে আসেন। এরপর ঢাকায় গিয়ে সুবাহদার শায়েস্তা খাঁর সম্মতি নিয়ে হরিহরনগরে ফিরে আসেন। রাজা উপাধি পাওয়ায় এলাকায় আনন্দ-উল্লাস করা হয়। রাজা উপাধি পেলেও তাঁর কোনো রাজধানী ছিল না। তখন তিনি রাজধানী স্থাপন করার চিন্তা করেন। ভূষণার কাছে হওয়ায় হরিহরনগরকে রাজধানী হিসেবে তিনি পছন্দ করেন নি। তাঁর বাবার আমলে মধুমতি নদীর পশ্চিম পাড়ে শ্যামনগরে ছোট-খাট একটা জোত বা তালুক ছিল। সেখান থেকে খাজনা আদায় হতো। ভবিষ্যতের কথা অর্থাৎ মুগল ও নবাবদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা চিন্তা করে নিরাপদ একটি এলাকায় রাজধানী স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। শ্যামনগরের বাগজানি এলাকায় রাজধানী স্থাপন করা হয় । এর কারণ পূর্ব পাশে মধুমতি নদী, উত্তর-পশ্চিম পাশে ছিল বড় বিল এবং দক্ষিণ পাশে রামসগরের মতো বড় জলাশয় কাটা হয়। চারপাশে গড় দিয়ে বেষ্টিত করা হয়। এর ফলে এলাকাটি সুরক্ষিত হয়। রাজধানীর নামকরণ করা হয় মহম্মদপুর। কারো কারো মতে, সেখানে মহম্মদ শাহ নামে একজন দরবেশ ছিলেন। তাঁকে সেখান থেকে সরে যেতে বলায় তিনি রাজি হন নি। তাঁর নামে রাজধানী করার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি সরতে রাজি হন। ঐতিহাসিকেরা এটা সঠিক বলে মনে করেন না। কারণ সেখানে কোনো দরগার অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যাইনি।
অনেকের মতে, মুগল সম্রাটের অধীনে যেহেতু রাজত্ব করতে হবে অথবা তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যদি নামতে হয়, তাহলে হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত শক্তি বা সমর্থন ছাড়া এটা সম্ভব ছিলনা। তিনি নিজে হিন্দু ছিলেন। এ কারণে নবী পয়গম্বরের নামে রাজধানীর নামকরণের ফলে হিন্দু-মুসলমানের মিত্রতা এবং সমদৃষ্টিতে দেখার যে মনোভাব, তা প্রমাণ করার জন্য মহম্মদপুর নামকরণ করেন। দ্রুতই এলাকাটি সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা আসেন। অস্ত্র তৈরী করার জন্য কামারশালা গড়ে তোলেন। মুগলরা নৌবাহিনীতে খুব দুর্বল ছিলেন, এটা সীতারাম জানতেন। এ কারণে তিনি সুদক্ষ একটি নৌবাহিনী গড়ে তোলায় মনোযোগী হন। দ্রুতগতির সিপ নৌকা দিয়ে তাঁর নৌবাহিনী সাজান। কিন্তু এই নৌকা চোর-ডাকাত দমনের জন্য ফলপ্রসূ হলেও যুদ্ধের জন্য মানানসই ছিল না। এজন্য প্রয়োজন হয় বড় নৌকার। তাতে কামান স্থাপন করা যায়। সে ধরণের কোনো নৌকা তিনি সংযোজন করেননি। মহম্মদপুরের দক্ষিণ পাশে ছিল বড় রামসাগর। খাল কেটে মধুমতির নদীর সঙ্গে রামসাগর যুক্ত করেন। এর পাড়ে বড় বড় গাছ-গাছলি ছিল। সেখানে অবস্থান করতো নৌবাহিনী। কিন্তু শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার জন্য তিনি সময় পাননি। তাঁকে খুব দ্রুত রাজধানী গড়ে তুলতে হয়। তা খুব সুদৃঢ় ছিল না। এ কারণে তাঁর পতনের পর রাজধানীর স্মৃতিচিহ্ন দ্রুতই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তিনি স্বল্প সময় রাজত্ব করেন।
সীতারাম তাঁর রাজত্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। পাবনা পর্যন্ত তাঁর রাজত্বের সীমারেখা বর্ধিত হয়। দক্ষিণে সুন্দরবন পর্যন্ত। যশোরের চাঁচড়ার জমিদাররা একবার তাঁর এলাকায় আক্রমন করে। সীতারামের পরাক্রমের কাছে তাঁরা পরাভূত হয়। সীতারাম পাল্টা চাঁচড়া আক্রমন করলে তাঁরা বশ্যতা স্বাকীর করে তাঁর অধীনন্থ হয়। তিনি সমৃদ্ধ একটি রাজত্ব গড়ে তোলেন। ১৬৮৬ সালে রাজ উপাধি পেলেও ১৬৯৯ সাল থেকে তিনি স্বাধীন রাজার মতো চলতে থাকেন। তিনি মুগলদের কর দেওয়া বদ্ধ করে দেন। দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করতে থাকেন। স্বাভাবিকভাবে তাঁরা বিক্ষুদ্ধ হন। মুর্শিদাবাদের নবাবরা তাঁকে পরাভূত করার উপায় খুঁজতে থাকেন। নাটোরের রাজা দয়ারামের সঙ্গে সীতারামের যোগসূত্র ছিল। তাঁর সঙ্গে কথা ছিল, তিনি তাঁকে সহযোগিতা করবেন। পরবর্তীকালে দয়ারাম বিশ্বাস ঘাতকতা করে মুর্শিদাবাদের নবাবদের সঙ্গে যোগ দেন। নবাবের সৈন্যরা যখন পূর্ব দিক দিয়ে মহম্মদপুর আক্রমণ করে, তখন প্রধান সেনাপতি রামরূপকে রাজধানীতে রেখে যান এবং দয়ারামের উপর আশ্বস্ত হয়ে তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে ভূষনায় অবস্থান নেন সীতারাম। এ সময় দুঃখজনক একটি ঘটনা ঘটে। রামরূপ প্রতিদিন ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে স্নানাদি সেরে পূজা-পার্বণ সারতেন। সেই সময় একদিন কুয়াশার মধ্যে মধুমতি নদী থেকে স্থাপন করে ফেরার পথে তাঁকে পেছন দিক থেকে গুপ্ত ঘাতক এসে হত্যা করে। এ কারণে সীতারাম হতবল হয়ে যান। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পশ্চিম দিক থেকে এসে দয়ারাম মহম্মদপুরের চারপাশে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। দয়ারামের বিশ্বাসঘাতকতা বুঝতে পেরে সীতারাম ভূষণা থেকে যতটা সম্ভব সেনাবাহিনী নিয়ে রাজধানীতে ফিরে এসে দয়ারামকে রুখে দিতে সচেষ্ট হন। কিন্তু ভূষণা থেকে নবাবের সেনাবাহিনী আর পশ্চিম দিক থেকে দয়ারামের বাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ চালালে সীতারাম পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর কামানগুলো ক্রমান্বয়ে হাতছাড়া হতে থাকে। একপর্যায়ে যুদ্ধে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দয়ারামের সেনাবাহিনীর হাতে তিনি বন্দি হন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। কারো কারো মতে, যুদ্ধের সময় তিনি সপরিবারে আগুনে আত্মাহুতি দেন। আবারো কারো কারো মতে, রামসাগরে সপরিবারে নৌকা ডুবিয়ে প্রাণত্যাগ করেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, দয়ারাম জলপথে তাঁকে বন্দি অবস্থায় নাটোরে নিয়ে যান। নাটোরের রাজবাড়ির কারাগারে তাঁকে এক রাত বন্দি করে রাখা হয়। পরের দিন দয়ারাম নিজে তাঁকে মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে পৌছে দেন। প্রকৃত ঘটনা জানা না গেলেও মুর্শিদাবাদেই তাঁর পরলোকগমন হয়। হয় কারাগারে অসুস্থ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয় অথবা নবাব তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেন। ১৭১৪ সালের অক্টোবরে তাঁর মৃত্যু হয়। কোথায় তাঁর শ্রাদ্ধ হয়েছিল, সে এলাকা মুর্শিদাবাদে এখনও চিহ্নিত করা আছে।
প্রায় ২০০ বছর আগে রাজা সীতারাম রায় পরলোগমন করলেও তাঁর কীর্তি এখনও অমলিন হয়ে আছে। তিনি দক্ষ শাসক হিসেবে প্রশংসিত হন। তিনি জনগণের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে. তিনি এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। কঠোর হস্তে চোর-ডাকাত, জলদস্যু দমন করেন। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। তাঁর অস্ত্র ভান্ডার ছিল খুব সমৃদ্ধ। দেশীয় কামারদের নিয়ে অস্ত্রের কারখানা গড়ে তোলেন। তাঁরা আশ্চর্যজনকভাবে কামানও তৈরি করেছিল। মুর্শিদাবাদে এখনও একটি কামান রাখা আছে। তাতে লেখা আছে জনার্দন কর্মকার। তাঁর প্রধান দুটি কামান ছিল। তার নাম ছিল কালে খাঁ ও ঝুমঝুম খাঁ। অনেক জনহিতকর কাজ তিনি করেন। সে সময় জলকষ্ট দূর করা একটা মহৎ কাজ ছিল। এলাকাবাসীর সুপেয় জল পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল। সবাই নদী-নালা, খাল-বিলের জল পান করতেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় জলাশয় বা দীঘি খনন করেন। তাঁর যেখানে রাজত্ব ছিল সেখানকার অধিকাংশ স্থানে দেখা যায়, সীতারাম রাজার পুকুর বা রাজার পুকুর। শীতকালে তিনি বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে খাজনা আদায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করতেন। সঙ্গে থাকতো সেনাবাহিনী। সেখানে রাত্রিযাপনের জন্য তাঁবু ফেলতেন। পুকুর খননের জন্য কৌশলী একটা পন্থা তিনি অবলম্বন করতেন। বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে তিনি বলতেন, নতুন পুকুরের জল দিয়ে তিনি সকালে জলখাবার খাবেন। পুরো সেনাবাহিনী ভোর রাতে পুকুর কাটতে শুরু করে দিত। সকালের আগেই নতুন পুকুর হয়ে যেত। সেই পুকুরের জল দিয়ে জলখাবার খেতেন। এ কারণে তাঁর এলাকায় অনেক পুকুর গড়ে ওঠে। সুপেয় জলের এই ব্যবস্থা করে দেওয়ায় তিনি দারুনভাবে প্রশংসিত হন। অনেক সুদৃশ্য ও কারুকার্য্যমন্ডিত মন্দির নির্মান করেন। নিজ মাতার নামে দয়াময়ী মন্দির, কানাইনগর পঞ্চরত্ন মন্দির ইত্যাদি ।
রাজধানীর সুরক্ষার জন্য যে নগর পরিকল্পনা করেন, সে সময়ের প্রেক্ষাপটে তা অত্যন্ত যুগোপযোগী ছিল। তিনি রণকৌশলী ছিলেন। রাজধানীর একপাশে ছিল বেগবান মধুমতি নদী। বাকিটা গড়বেষ্টিত। গড় মানে নদীর মতো খনন করা পরীখা। গড়ের পাড়ে ছিল মাটির উঁচু প্রাচীর। গড় থেকে বাইরে আসার জন্য বড় কাঠের অস্থায়ী সেতু ছিল। সেই সেতুর উপর দিয়ে হাতি চলাচল করতে পারতো। রাতের বেলা হাতি দিয়ে কপিকলের মাধ্যমে টেনে সেই সেতু সোজা করে রাখা হতো। খাড়া হয়ে থাকার কারণে তার উপর দিয়ে আসা যাওয়া করা যেত না। রাতের বেলা রাজধানীতে প্রবেশের কোনো সুযোগ থাকতো না। রাজধানীর মাঝখানে ছিল ট্রেজারি পুকুর। তলা থেকে উপর পর্যন্ত পাকা করা ছিল। পুকুরের তলায় চাড়ি দিয়ে অনেকগুলো কুয়ো করা ছিল। যাতে পুকুর জলপূর্ণ থাকে। কথিত আছে, এই পুকুরে টাকা-পয়সার সিন্ধুক রাখা হতো। এটা সঠিক নাও হতে পারে। আমার মনে হয়, প্রাকারবেষ্টিত এই পুকুরে অন্দরের মেয়েরা যাতে আব্রু রক্ষা করে স্নান করতে পারেন, সেজন্য এটা খনন করা হতে পারে। তিনি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। কর ব্যবস্থা যুগোপযোগী করেন। কর দেওয়ার জন্য একটা প্রথা চালু করেন। কর কখন বৃদ্ধি হবে, কীভাবে বৃদ্ধি হবে, কতদিন নিস্কর থাকবে, কী পরিমাণ খাজনা হবে, কীভাবে খাজনা দিতে হবে, এ ব্যাপারে একটা সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার আওতায় আনেন। এ রকম অসংখ্য কাজ করেছেন, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে অন্যরা সেটা ভাবতেই পারতেন না।
পাবনা থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত দক্ষিণ বাংলার এই বিস্তির্ণ এলাকার রাজা ছিলেন রাজা সীতারাম রায়। মহম্মদপুর ছিল এই রাজ্যের রাজধানী এবং এক সমৃদ্ধ নগরী। মহম্মদপুরের সেই গৌরবজনক অধ্যায় এখন আর নেই। রাজা সীতারামের আমলের রাজবাড়ীর কাছারী বাড়ীটি আজও অক্ষত আছে। ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে অনেক দর্শনাথী এই ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার জন্য মহম্মদপুরে আসেন। জনহিতকর রাজা হিসাবে ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম রায়ের নাম। সে নাম কখনও মুছে যাবে না।
লেখক: ড. শ্রী বীরেন শিকদার, এমপি, মাগুরা-২
সাবেক প্রতিমন্ত্রী, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।