মিলন দাস
এই উপমহাদেশের অন্যতম ইসলাম প্রচারক ও সূফি সাধক খানুল আজম উলুঘ যিনি আমাদের কাছে খানজাহান আলী বা খাজা খাঞ্জেয়ালী নামে পরিচিত। ইসলামের এই সাধক পুরুষ এই উপমহাদেশে সেনাপতি হিসেবে আসলেও তার পরিচিতি লাভ হয় একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক হিসেবে। তার প্রকৃত নাম খানুল আজম উলুঘ বা খান ই আজম আর উপাধি হলো খান ই জাহান (খানজাহান) । তার নিজের নাম সাধারনের কাছে পরিচিতি না পেলেও উপাধিটিই সবার হৃদয়ে তার নাম হিসেবে গ্রথিত হয়। সেই থেকেই এই যোদ্ধা ও ইসলাম প্রচারক খাজা খানজাহান আলী নামেে সমধিক পরিচিতি অর্জন করে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বাগেরহাট অঞ্চলের স্থানীয় শাসক। অসমর্থিত সূত্রে জানাযায় এই মহান সাধক খানজাহান আলি (র.) তেরশত উনসত্তুর সালে তৎকালীন ভারতবর্ষের দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেন। সেখানকার আকবর খাঁ ও আম্বিয়া বিবি তার পিতা-মাতা। মনে করা হয় তার পূর্বপুরুষ তুরস্কের বাসিন্দা ছিলেন। খানজাহান আলি শিক্ষা গ্রহণ শেষে দিল্লির বিখ্যাত ওয়ালি কামিল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে কুরআন, হাদিস, সহ বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন করেন।খানজাহান আলি তেরশো উনানব্বই সালে সেনা বাহিনীতে কর্ম জীবন আরম্ভ করেন। খুব কম সময়ে তিনি প্রধান সেনাপতি পদে আসীন হন। যুবক বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান’র (গভর্নর) পদে যোগ দেন। অনুমান করা হয় পরবর্তীতে সুলতান খানজাহান ষাট হাজার সুশিক্ষিত সেনাদল ও দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে ষোল শতকে এই অঞ্চলে আসেন তখন এই অঞ্চলটি খলিফাবাদ নামে পরিচিত ছিল । এ অঞ্চলে তখন রাজা ছিলেন গণেশ। খানজাহান আলী’র আক্রমনে ভয় পেয়ে রাজা গনেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতে আশ্রয় নেন (ধারনা করা হয়)। এ অঞ্চল দখলের পর খানজাহান আলী যশোরের বারবাজারে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার আরম্ভ করেন। তার শাসন এলাকায় অসংখ্য মসজিদ, রাস্তা ও পুকুর খনন করেন এর মধ্যে বিবি বেগনি ও সোনা মসজিদ দুটির গুরুত্ব অনেক। ধারনা করা হয় এই মসজিদ দুটি তার দুই সহধর্মিনী বিবি বেগনি ও সোনা বিবির স্মৃতি ধরে রাখতে তাদের নাম অনূসারে নির্মান করে ছিলেন। কথিত আছে খানজাহানের প্রথম স্ত্রীর সোনা বিবি ছিলেন খানজাহানের পীর নুর-কুতুবুল আলমের একমাত্র কন্যা এবং দ্বিতীয় স্ত্রী রূপা বিবি ওরফে বিবি বেগনি ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান। এ ছাড়াও এখনও খানজাহান আলীর সমাধিসৌধ, ষাট গম্বুজ, সিঙ্গাইর, চুনাখোলা, রেজাখোদা, নয়গম্বুজ,রনবিজয়পুর মসজিদ, জিন্দা পীরের মাজার আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। ধারনা করা হয় চৌদ্দশো উনপঞ্চাশ সালের আগে ষাট গম্বুজ মসজিদটি ইসলাম প্রচারক খানজাহান আলী (র:) নির্মান করেন।

এই ঐতিহাসিক মসজিদটি উনিশশো পঁচাশি সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। পনেরো শতকে নির্মিত ষাটগম্বুজ মসজিদটি মধ্যযুগীয় এ দেশীয় স্থাপত্য শিল্প ও তুর্কি স্থাপত্য শিল্পের স্বাক্ষর বহন করে। এটি লাল পোড়া মাটির উপর নানা কারুকাজে নির্মিত এ মসজিদটি ষাটগম্বুজ নামে পরিচিত হলেও এর নির্মানশৈলী চার কোনা বুরুজের উপর চারটি গম্বুজ সহ এতে রয়েছে একাশিটি গম্বুজ । দেশের বৃহত আয়তকার মসজিদটির দৈর্ঘ প্রায় উনপঞ্চাশ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় তেত্রিশ মিটার । মধ্যে রয়েছে আমাদের ঘরের চালের আদলে সাতটি চৌচালা গম্বুজ। ষাটটি নকশা করা খাম্বার উপর দাড়িয়ে আছে এ ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি। এ ছাড়াও লাল পোড়া মাটির ইটে তৈরি বিশাল এক একটি দেওয়াল, নকশাকরা দশটি মেহরাব, বাকানো কার্নিশ এবং পশ্চিম দিকের দেওয়ালে একটি আলাদা প্রবেশ পথ রয়েছে। হযরত খানজাহান আলি (র.) পচিশ অক্টোবর চৌদ্দশো উনষাট সালে জিলহাজ মাসের ছাব্বিশ তারিখ আটশত তেষট্টি হিজরিতে (মাজার শরীফের শিলালিপি অনুযায়ী) ষাট গম্বুজ মসজিদে এশার নামাজ পড়ার সময় নব্বই বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। খান জাহান আলী( র:)’র এই মাজারে চৈত্র মাসের পূর্ণিমায় ওরস অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশ থেকে লক্ষাধিক লোক এ অনুষ্ঠানে সমবেত হয়। এই পবিত্র মাজার ও ষাটগম্বুজ মসজিদের সাথে জড়িয়়ে আছে দুটি দিঘির নাম ঠাকুর দিঘী ও ঘোড়া দীঘি। খানজাহান আলীর মাজারের পাশে যে দীঘিটি সেটি ঠাকুর দীঘি নামেে পরিচিত। এক সময়েে মিঠা পানির এই পুকুরে কালা পাাহড় ও ধলা পাহাড় নামে দুুুুটি কুমির ছিল। ছয়শো বছরেের ইতিহাস এর স্বাক্ষ্য বহন কারি কালা পাহাড়ের মৃত্যু হলে এই ঐতিহ্যবাহী মাজারের কুমির ইতিহাস পর্বের সমাপ্তি ঘটে। বিশ্ব বিখ্যাত ষাটগম্বুজ মসজিদের পশ্চিম দিকে রয়েছে বিশাল এক দীঘি। এই দীঘিটি ঘোড়াদীঘি বা খাঞ্জিলীর দীঘি নামে পরিচিত। দীঘির পূর্ব-পশ্চিমে বারোশো সাতচল্লিশ ফুট এবং উত্তর-দক্ষিণে সাতশো চল্লিশ ফূট দীর্ঘ। দীঘিটি মগড়া,সুন্দর ঘোনা,বাজেয়াপ্তি তিনটি মৌজার প্রায় চল্লিশ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। নাম করণের পেছনে রয়েছে এক অন্যরকম ইতিহাস। শ্রূতি কাহিনী অনুযায়ী খানজাহান আলী (র:) এই দীঘি খননের পরেও পানি না উঠলে তিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে দীঘির ভিতরে নেমে ভ্রমনের পরে দীঘিটি জলে পূর্ণ হয়ে উঠে। সেই কারনেই এই দীঘির নাম রাখা হয় ঘোড়াদীঘি। এক সময় এই অঞ্চলের মানুষ এর জল পান করতো। ওখানকার লোকজনের ধারনা এই দীঘিতে গোসল করলে বা এর জল পান করলে রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সহ মনোবাসনা পূর্ণ হয়ে যায়। উনিশো ছিয়াশি সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি (জলাশয় ) হিসেবে সরকার এটিকে তালিকাভুক্ত করে।

কথা হয় মাজারের খাদেম ফকির মোহম্মদ রাসেল আলী রাজের সাথে তিনি বলেন সারা দেশ থেকে খানজাহান আলীর হাজার হাজার ভক্ত আসেন প্রতিদিন । খানজাহান আলী’র মাজারের পাশের কবরটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন ওটি হচ্ছে খানজাহান আলী (র:)’র প্রধান খলিফা ফকির মোহম্মদ আবু তাহেরের । আবুু তাহের ছিলেন যশোরের এক ব্রাক্ষণ পরিবারের সন্তান। খানজাহান আলী (র:) জীবদ্দশায় আবু তাহের ছিলেন তার প্রধান খলিফা। প্রিয় পাঠক চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত খাজা খানজাহান আলী’র পূর্ণভূমি বাগেরহাটে। সড়ক পথে দেশের যে কোন অঞ্চল থেকেই পৌছে যেতে পারবেন এ ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক