বিশেষ প্রতিনিধি, মাগুরাবার্তা
আজ ১৯ নভেম্বর। মুক্তিযুদ্ধে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার রণাঙ্গণের ইতিহাসে এই দিনটি বড়ই শোকাবহ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপজেলা সদরে সংগঠিত রাজাকারদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন হাবিুবুর রহমান মহম্মদ (২৭) ও আহম্মদ হোসেন (২৫) নামের সহোদর। একই সাথে শাহাদৎবরণ করেন তৎকালিন ইপিআর সদস্য মহম্মদ আলী নামের আরেক বীর যোদ্ধা। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এদেশ শত্রুমুক্ত করতে এই তিনজন অসামান্য অবদান রাখেন।

মহম্মদপুর উপজেলার দীঘা ইউনিয়নের পাল্লা গ্রামের আফসার উদ্দিনের ছেলে মহম্মদ ও আহম্মদ। ইপিআর সদস্য মহম্মদ আলী যশোরের রূপদিয়া এলাকার বাসিন্দা। এই তিনজনেরই কবর মহম্মদপুরের নাগড়িপাড়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে।

এই যুদ্ধে অংশ নেন সদরের গোপালনগর গ্রামে বাসিন্দা তৎকালিন ইপিআর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা তোজাম্মেল হোসেন। তিনি জানান, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১। ঈদুল ফিতরের আগের দিন শুক্রবার। রাত আনুমানিক ৯টা। মহম্মদপুর সদরের মধুমতি পাড়ের পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের ঝামা গ্রামে বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হতে শুরু করেন। লক্ষ্য মহম্মদপুর সদরের টিটিডিসি হলে ওয়েস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর (ডব্লিউপিআর) রেঞ্জার্স ফোর্সের সমন্বয়ে শক্ত ঘাঁটিতে অপারেশন পরিচালনা করা।

‘ভোর চারটার দিকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ি মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে চারদিক দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধা গোলাম ইয়াকুব, কমল সিদ্দিকী, নূর মোস্তফা এবং আবুল খায়ের ও তোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে দুইশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা টিটিডিসি হলের চারপাশ ঘিরে ফেলেন। চারটি দলের সাথে আমি প্রথম রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমন চালাই’, বলেন তোজাম্মেল হোসেন।

উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ সময় গুলি বিনিময় চলতে থাকে। সুসজ্জিত ওয়েস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ডব্লিউপিআর) রেঞ্জার্স ফোর্স অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। এক পর্যায়ে চারটি দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। সুরক্ষিত কংক্রিটের বাংকার থেকে ভারি অস্ত্রের গুলি ছুড়তে থাকে অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে কোন নিরাপত্তা ব্যুহ ছিলনা।

একপর্যায়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন অংশ নেওয়া দুই ভাইয়ের ছোট ভাই আহম্মদ হোসেন। তাকে সরিয়ে এনে সড়কের পাশে পুকুরের পাশে আশ্রয় নেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় ভাই হাবিবুর রহমান মহম্মদ ভাইকে বাঁচাতে এসে গুলিবিদ্ধ হন। এক পর্যায়ে আমার দুই হাতের উপর শহীদ হন দুই সহোদর, জানান তোজাম্মেল হোসেন।

এই যুদ্ধে পাকিস্তানি দোসরদের ১০-১৫ জন নিহত হয় বলে তারা জানতে পারেন।

তোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘দুই ভাইয়ের টকটকে লাল রক্তের স্মৃতি আজও আমার চোখে ভাসে। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই ফিনকি দিয়ে সহোদরদের রক্ত বের হচ্ছে। আহম্মদ-মহম্মদের মৃতদেহ একপর্যায়ে পুকুরের পানিতে পড়ে যায়। আমরা চলে গেলে রাজাকাররা আহম্মদ-মহম্মদের লাশ নিয়ে উল্লাস করতে থাকে।

মহম্মদ ও আহম্মদ দুই ভাই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। মো. হাবিবুর রহমান মহম্মদ ঝিনাইদহ সদরের সাগান্না প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আহম্মদ হোসেন পাল্লা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ছিলেন। শহীদ মহম্মদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৬৫), তিন ছেলে ও এক মেয়ে বেঁচে আছেন। শহীদ আহম্মদ হোসেন ছিলেন অবিবাহিত।

শহীদ মহম্মদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘স্বামী তার ছোট ভাইসহ তিনজন বীরযোদ্ধা একই সাথে শহীদ হন। অনেক কষ্ট ত্যাগ হয়ত সহ্য করেছি। তবে না পাওয়ার কোন বেদনা বা অতৃপ্তি নেই। কারণ তারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।’

শহীদ মহম্মদের বড় ছেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দুই সহোদরের আত্মবলিদানের ঘটনা খুবই বিরল। তাদের ত্যাগ দেশকে শত্রু মুক্ত করতে প্রেরণা যুগিয়েছিল।’

মহম্মদপুর উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে শহীদ সহোদরের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদদের পরিবারের উদ্যোগে আজ নিজ গ্রাম পাল্লায় আলোচনা, কবর জিয়ারত, মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

শাহীন/ রূপক/ মাগুরা/ ১৯ নভেম্বর ২০২১